অভিরূপ দাস: মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন স্টেথোধারীরা। সে যুদ্ধেই প্রাণ যাচ্ছে একের পর এক চিকিৎসকের। নয় নয় করে শনিবার সেই সংখ্যাটা দাঁড়াল ১২৬। গত ২৪ ঘন্টায় সার্স কোভ ২-এর হানায় আরও ৪ ডাক্তার প্রয়াত হয়েছেন। যা দেখে শুনে আতঙ্কে রাজ্যের চিকিৎসকরা। দেশে ১১,০৮২ জন রোগী পিছু চিকিৎসক মাত্র ১ জন! বাংলায় সেই সংখ্যাটা সামান্য ভাল হলেও খুব খুশি হওয়ার মতো নয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৯.২০ কোটি জনতার চিকিৎসার জন্য রয়েছেন মাত্র ৬৯ হাজার চিকিৎসক (Doctor)। সোজা অঙ্কে রাজ্যে প্রতি ১৩৩০ জন রোগীর জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের রাজীব পাণ্ডের কথায়, “তাহলেই বুঝুন চাপটা কেমন।”
এমনিতেই চিকিৎসক পাওয়া যায় না। তার উপর করোনার (COVID-19) আঘাতে একের পর এক ডাক্তারের মৃত্যুতে চিকিৎসকদের প্রশ্ন, করোনা ছাড়াও তো অসংখ্য অসুখ রয়েছে, সেসব রোগ চিকিৎসার জন্য এরপর ডাক্তার পাওয়া যাবে তো? ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডা. কৌশিক চাকির কথায়, “পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত পাঁচ-সাত বছরে রাজ্যে তিন গুন বেড়েছে ডাক্তারি আসন। আগের চেয়ে এখন ঢের বেড়েছে প্রতি বছর ডাক্তার তৈরির সংখ্যা। তেমন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ফি দিন বিপুল সংখ্যক রোগী আসেন। একেক জন চিকিৎসককে দীর্ঘ সময় ধরে, রোগী দেখে যেতে হয়।”করোনা আবহে যেভাবে চিকিৎসকরা প্রাণ হারাচ্ছেন তাতে আগামী দিন সেই চাপ পাহাড় প্রমাণ বাড়বে বলেই মনে করছেন ডাক্তাররা।
[আরও পড়ুন: হাসপাতালের বেডে বসেই দিয়েছিলেন জীবনকে ভালবাসার পাঠ, মৃত্যু হল সেই তরুণীরও]
শুক্রবার করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন স্বনামধন্য প্যাথলজিস্ট সুবীর দত্ত। এদিন সকাল ১০টা নাগাদ ঢাকুরিয়া আমরি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। ৮৫ বছর বয়সী প্রবীণ এই প্যাথলজিস্ট গত ২৫ এপ্রিল থেকে ভরতি ছিলেন হাসপাতালে। শ্বাসকষ্টের কারণে সেদিন থেকেই তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। কলকাতার তালতলায় বেসরকারি নমুনা পরীক্ষা কেন্দ্র সায়েন্টিফিক ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরির এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন ডা. সুবীর দত্ত। প্রসিদ্ধ ওই প্যাথলজিস্টকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান রাজ্যের চিকিৎসক মহল। এক সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিভাগের ডিনও ছিলেন সুবীরবাবু। জাতীয় স্তরেও নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কয়েকবছর আগে সংবাদ প্রতিদিন চিকিৎসা জ্যোতি সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল এই প্রখ্যাত চিকিৎসককে। রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রর কথায়, “ওনার মৃত্যুতে পিতৃবিয়োগের যন্ত্রণা অনুভব করছি।”
এদিন করোনা আক্রান্ত আরও এক চিকিত্সকের মৃত্যু হয়েছে অ্যাপোলো হাসপাতালে। উত্পল সেনগুপ্ত নামে ওই চিকিত্সক বারাসাত হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক সতীশ ঘাঁটা। স্বনামধন্য এই চিকিৎসক নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী।
তবে চিকিৎসকরা মর্মাহত সন্দীপন মণ্ডলের মৃত্যুতে। ৩৭ বছরের তরুণ তরতাজা এই চিকিৎসক মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের সিক নিউবর্ণ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। প্রতিভাবান এই তরুণ চিকিৎসকের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম। ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ডা. কৌশিক চাকির কথায়, “সন্তান জন্মের পর তার বাবাকে দেখতে পাবে না। রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে আমাদের অনুরোধ এই তরুণ চিকিৎসকের পরিবারের দায়িত্ব নিন।” মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের সুপার অমিয় বেরা জানান, ডা. সন্দীপনকে তিনি বার বার টিকা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেকথা শোনেননি প্রয়াত চিকিৎসক। কোনও কো-মর্বিডিটি ছিল না তরুণ চিকিৎসকের। টিকা নেওয়া থাকলে হয়তো বেঁচে যেতেন তিনি। আক্ষেপ অমিয়বাবুর।
দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে একাধিকবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন ডাক্তাররা। দেশে ৫৫,৫৯১ জন বাসিন্দার জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি সরকারি হাসপাতাল। তাতেও রোগীপিছু একটা বেড মেলে না! কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, জন ঘনত্বে পশ্চিমবঙ্গ দেশের পয়লা নম্বর রাজ্য হলেও এখানে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকের সংখ্যা এখনও বেশ কম আর পাঁচটা রাজ্যের তুলনায়। ফলে এ রাজ্যে চিকিৎসক-রোগীর অনুপাতও মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলির তুলনায় বেশ খারাপ। সেখানে একের পর ডাক্তারের মৃত্যু আগামী দিনের জন্য অত্যন্ত খারাপ বার্তা নিয়ে আসছে বলেই মত চিকিৎসকদের।