সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: টানা ৮ দিন বাংলায় চড়কিপাক। এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গল। রীতিমতো হন্যে হয়ে জিনাতকে খুঁজে না পেয়ে বনদপ্তরের সাতদিনের বাঘবন্দি অভিযানের সাঁড়াশি আক্রমণে আবার ঝাড়খণ্ডে ফিরে গেল তার পুরুষসঙ্গী। যে পথ দিয়ে সে বাংলায় প্রবেশ করেছিল সেই পথ অর্থাৎ হাতির করিডর দিয়েই দলমা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য লাগোয়া জামশেদপুর বনবিভাগের ঘাটশিলা বনাঞ্চলে ঢুকে যায়।
ঝাড়খণ্ডের পথে রয়্যাল বেঙ্গল। ছবি: বনদপ্তর
ঝাড়খণ্ড বনবিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার বিকাল পর্যন্ত ওই বনাঞ্চলের কালাঝোড় এলাকায় রয়েছে। তার পদচিহ্ন পেয়েছে জামশেদপুর বনবিভাগ। এদিকে বাংলা ছেড়ে ঝাড়খণ্ডমুখী হওয়ার পায়ের ছাপও সংগ্রহ করেছে রাজ্যের বনদপ্তর। শনিবার বিকাল থেকে শুরু হওয়া ৪৮ ঘণ্টার সাঁড়াশি অভিযান এদিন বিকালে শেষ হলেও আরও ৭২ ঘন্টার নাইট ওয়াচিং-র পাশাপাশি বনাধিকারীকদের তদারকি চলবে। থাকবেন সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের বিশেষজ্ঞরাও। কারণ সে যে জিনাতের পথ ধরে আবার ফিরবে না তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগ।
ঝাড়খণ্ডের পথে রয়্যাল বেঙ্গল। ছবি: বনদপ্তর
এই বাঘবন্দি অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা রাজ্যের মুখ্য বনপাল (পশ্চিম চক্র) সিঙ্গরম কুলান ডাইভেল বলেন, "জিনাতের পথ ধরে যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটি বাংলায় এসেছিল। সেটি আবার ঝাড়খণ্ডে ফিরে গিয়েছে।ঝাড়খণ্ডে যাওয়ার তার যেমন পদচিহ্ন মিলেছে। তেমনই ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা বনাঞ্চল কর্তৃপক্ষ তাদের নিশ্চিত করে জানিয়েছে ওই এলাকায় থাকা বাঘের পায়ের ছাপ থেকে তারা পরিষ্কার ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটি সেখানে রয়েছে। অভিযান আপাতত বন্ধ হলেও ৭২ ঘন্টা নজরদারি চলবে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ টিমও বান্দোয়ানে থাকছেন।" ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর বনবিভাগের ডিএফও সাবা আলম আনসারি বলেন, "ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটি জামশেদপুর বনবিভাগে রয়েছে। আমরা তার পায়ের ছাপ পেয়েছি। আমরা ধারাবাহিক নজরদারি চালাচ্ছি। মানুষজনকে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে।" এখন ঘাটশিলায় ভরা পর্যটনের মরশুম। ফলে ঠাসা পর্যটক। আর সেখানে রয়্যাল বেঙ্গল চলে যাওয়ায় তীব্র আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ওই পাহাড়-জঙ্গল পর্যটন কেন্দ্রে।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের ঝাড়খণ্ড সীমানায় বাঘের পদচিহ্ন দেখছেন রাজ্যের মুখ্য বনপাল ( দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকার। ছবি: বনদপ্তর
বনদফতরের সাঁড়াশি অভিযানেই রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গর্জনে প্রতিবাদ জানিয়ে সোমবার ভোর রাতে বাংলার সীমানা ছাড়ে ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বাংলা থেকে প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সে। বান্দোয়ানের কাঁটাপাহাড় থেকে ঝাড়খণ্ডের পটমদা থানার বুড়াবুড়ি পাহাড়ে আসে জিনাত সঙ্গী। তারপর গোবরঘুষি, বাটালুকার জনপদ ছুঁয়ে ঘাটশিলায় যায়। বাটুলুকা গ্রামের কঙ্কা সরেনের ঘর থেকে ২০০ মিটার দূরে এদিন সকালে ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের পায়ের ছাপ দেখে ঝাড়খন্ড বনবিভাগ। এরপরেই বাঘ থেকে সতর্ক থেকে সচেতনতার প্রচার চালায় বনদপ্তর। বাটালুকা গ্রামের বাসিন্দা যুধিষ্ঠির মেহতা বলেন, "আমি সবার প্রথমে এই এলাকায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখি। আমার বাগানের মধ্যে ওই ছাপ দেখে ভয় কেঁপে যাই। স্থানীয় মানুষজনকে জানানোর পর বনদপ্তরকে জানানো হয়।"
ঝাড়খন্ডে বাঘের পদ চিহ্ন। ছবি: অমিতলাল সিং দেও।
কয়েক দিন ধরে জিনাতের পুরুষ সঙ্গী সন্ধ্যে থেকে বিভিন্ন এলাকায় পদচারণা করে রাইকা পাহাড়ের কাছে ভাঁড়ারি ও যমুনাগোড়াতেই ফিরে আসছিল। ওই এলাকায় ২ দিন ধরে তার ছবি মিলছিল ট্র্যাপ ক্যামেরায়। তাই রবিবার কাঁটাপাহাড় এলাকায় সাঁড়াশি আক্রমণের পাশাপাশি যমুনাগোড়ার জঙ্গল এলাকায় গাছে মাচা বেঁধে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের শুটাররা ক্যামোফ্লেজে এমবুস করেছিলেন। কিন্তু রবিবার রাতে আর সেখানে যায়নি জিনাত প্রেমিক । যেমনভাবে শনিবার সকালে ট্র্যাপ ক্যামেরায় দুটো ছবি ধরা পড়লেও তার পাশেই খাঁচার মধ্যে থাকা ছাগলের টোপে আকৃষ্ট হয়নি। ওই টোপের চারপাশে আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে বাঘিনীর মূত্র নিয়ে এসে সেখানে স্প্রে করা হলেও আকর্ষিত হয়নি জিনাত সঙ্গী। সে যে জিনাতকেই খুঁজছে!
ঝাড়খন্ডে বাঘের পদ চিহ্ন। ছবি: অমিতলাল সিং দেও।
ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের কথায়, ওই বাঘটি যে আসলে জিনাতকেই খুঁজছে! এই কারণেই তার ফেলে আসা পথে বারবার পদচারণা। এভাবে হুলা পার্টিকে নিয়ে পটকা ফাটিয়ে অভিযান না হলে হয়তো ওই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার রাইকা পাহাড় ও পাহাড়তলি ছেড়ে যেত না। বলছেন বান্দোয়ানের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজন। এদিন সকাল থেকে বনকর্মী সহ আধিকারিকরা বাংলার সীমানায় ওই বাঘের পদচিহ্ন শুধু খুঁজে বেড়িয়েছেন। পায়ের ছাপ খুঁজতে ছিলেন
রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকারও। জিনাত প্রেমিক বিদায়ের নিশ্চয়তাই খানিকটা স্বস্তি বনদপ্তরে।