সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ ইতিহাস। তালিকাও দীর্ঘ। জরুরি অবস্থার সময় থেকে শুরু করে আশির দশকে দলত্যাগ বিরোধী বিল বা নব্বইয়ের দশকের মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে বিতর্ক, নানা সময়ে কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদের রাজনীতি (Paper-Tearing Politics) দেখেছে দেশবাসী। তবে সবচেয়ে বেশি শোরগোল ফেলেছিলেন রাহুল গান্ধী। ২০১৩ সালে। তাঁর নিজের দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের আনা একটি অধ্যাদেশের প্রতিলিপি ছিঁড়ে। পরবর্তীকালে কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদের রাজনীতিতে যাঁরা নাম লিখিয়েছেন, সেই তালিকায় একে একে নাম জুড়েছে অধীর চৌধুরী, শুভেন্দু অধিকারীর। এ বার নাম জুড়ল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও (Mamata Banerjee)।
মঙ্গলবার কোচবিহারে মমতার সভা ছিল। সেখানে কেন্দ্রের নয়া শ্রমবিধি নিয়ে সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ১০০ দিনের কাজে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন শর্ত চাপিয়েছে কেন্দ্র। সেই শর্তকে অসম্মানজনক আখ্যা দিয়ে এই সংক্রান্ত কেন্দ্রের একটি কাগজ সভায় ছিঁড়ে ফেলেন মমতা। তিনি বলেন, "তিন, চারদিন আগে আমাদের একটা নোটিস পাঠিয়েছে। কেন্দ্রের নতুন লেবার কোড নিয়ে। ১০০ দিনের কাজের টাকা দিতে নতুন শর্ত চাপিয়েছে। আমরা এসব শর্ত মানি না, মানব না। এটা অসম্মানের। এই কাগজ আমি ছিঁড়ে ফেলে দিলাম।"
মুখ্যমন্ত্রীর এই আচরণ নিয়ে আপত্তি তুলে সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীদের একাংশ। তাঁদের মত, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের পদে থেকে তাঁর থেকে এমন আচরণ কাম্য নয়। এই আচরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থি বলেও মত অনেকের। তবে পাল্টা অভিমতও রয়েছে। তা হল, মুখ্যমন্ত্রী সভায় যে কাগজটি ছিঁড়ে ফেলেছেন, সেটি কেন্দ্রের পাঠানোর কোনও প্রশাসনিক নথি নয়। কেন্দ্র যে শর্ত চাপিয়েছে, তা একটি কাগজে লিখে এনেছিলেন মমতা। সেটিই সভামঞ্চে ছিঁড়ে ফেলেন তিনি।
কেউ কেউ আবার এ প্রসঙ্গে রাহুলের অধ্যাদেশের প্রতিলিপি ছেঁড়ার কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ২০১৩ সালের মনমোহন সরকার দাগি সাংসদ-বিধায়কদের সদস্যপদ রক্ষায় একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত লালু প্রসাদের সাংসদ পদ বাঁচাতেই ওই অধ্যাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্টে দিয়ে পুরনো ব্যবস্থা বহাল রাখার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকার। তা নিয়ে সেই সময় প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন রাহুল। দিল্লির প্রেস ক্লাবে গিয়ে সেই অধ্যাদেশের প্রতিলিপি ছিঁড়েও ফেলেছিলেন। ঘটনাচক্রে, ২০২৩ সালে যে নিয়মে রাহুলের লোকসভার সদস্যপদ খারিজ হয়েছিল, তার ভিত্তিই ছিল ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়।
পরবর্তীকালে সংসদেও কাগজ ছেঁড়ার রাজনীতি দেখা গিয়েছে। ২০১৭ সালে লোকসভায় কাগজ ছিঁড়ে স্পিকারের রোষে পড়েছিলেন কংগ্রেসের অধীর, গৌরব গগইরা। দলিত, মুসলিমদের উপর আক্রমণ নিয়ে লোকসভায় আলোচনা চেয়েছিলেন অধীরেরা। তাতে রাজি হননি স্পিকার। তার প্রতিবাদেই ওয়েলে নেমে কাগজ ছিঁড়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদেরা। ছেঁড়া কাগজ স্পিকারের পোডিয়াম লক্ষ্য করেও ছোড়া হয়েছিল। এই ঘটনায় অধীর, গৌরব-সহ ছ'জন কংগ্রেস সাংসদ সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
২০২১ সালে রাজ্যসভায় পেগাসাস নিয়ে আলোচনা চলাকালীন হইহট্টগোলের সময় কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের হাত থেকে কাগজ কেড়ে নিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন (বর্তমানে সাসপেন্ডেড)। তা নিয়ে তীব্র বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন শাসক এবং বিরোধী শিবিরের সাংসদেরা। পরে মার্শাল ডেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। চলতি বছরে লোকসভায় সরকারপক্ষ তিন বিল পেশ করার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিলের কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদ দেখান বিরোধী সাংসদেরা। গত অগস্ট মাসে ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন শাহ। তার সঙ্গে পেশ করা হয়েছিল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকার (সংশোধনী) বিল, জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন (সংশোধনী) বিল। সেই বিলেরই কাগজ ছিঁড়ে শাহের দিকে ছুড়ে মারা হয়েছিল। এই ঘটনার পরে মুলতুবি করে দেওয়া হয় নিম্নকক্ষের অধিবেশন।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভাতেও কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিধানসভায় ওয়েলে নেমে কাগজ ছিঁড়ে প্রতিবাদ দেখানোয় সাসপেন্ড হয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও-সহ চার বিজেপি বিধায়ক।
