ঘরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে কাশ্মীর-নীতি, বাইরে দলের ধর্মান্ধ নেতাদের আলটপকা ঘৃণামিশ্রিত মন্তব্যের জের। পশ্চিম এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ইসলামি ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে রক্তচক্ষু দেখাতেই, দেখা গেল বিবৃতির বহর। রাতারাতি বরখাস্ত হলেন নবীন জিন্দল, নূপুর শর্মা। এতদিন ধরে ভিনদেশি সমালোচনা সত্ত্বেও যে-সরকার বিচলিত বোধ করেনি, হঠাৎ তারা কেন নিজেদের ধর্মীয় বোধ ও নীতি প্রতিষ্ঠায় এমন মরিয়া? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বেকায়দায় পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ঘরে ও বাইরে। সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন সাধ্যমতো। এতে তাঁর অবস্থান টলমলে হবে না ঠিকই, কিন্তু ভাবমূর্তি বড়সড় টোল খেয়েছে। ‘বিশ্বগুরু’ সেজে সবার সঙ্গে সবার ‘বিকাশ’-এর যে-কথা বড়মুখ করে বলে আসছেন, তা কতটা অসাড় প্রমাণ হয়ে গেল। ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর বিস্তর চেষ্টা চলছে। সময় সব ক্ষত জুড়িয়ে দেয়। কিন্তু ভরসা ও বিশ্বাস? কতটা ফিরবে, তা তর্কসাপেক্ষ।
ঘরে বেকায়দায় ফেলেছে কাশ্মীর নীতি, বাইরে বেকায়দায় পড়েছেন দলের ধর্মান্ধ নেতাদের আলটপকা ঘৃণামিশ্রিত মন্তব্যের জেরে। হজরত মহম্মদকে নিয়ে যে-কুমন্তব্য তাঁর দলের দুই নেতা-নেত্রী করেছেন, তাতে ক্ষুব্ধ সমগ্র ইসলাম দুনিয়া। পশ্চিম এশিয়ার একের পর এক দেশ প্রকাশ্যে ক্ষমা দাবি করেছে। তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে অর্বাচীন নেতাদের বজ্জাতি ও অবিমৃশ্যকারিতার। কালক্ষেপ না করে ভারত সরকারকে মাথা নোয়াতে হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের অপরিণামদর্শিতা সামাল দিতে নামানো হয়েছে কূটনীতিকদের। ঘুম ছুটেছে সাউথ ব্লকের। কেননা, পশ্চিম এশিয়ার গণ্ডি পেরিয়ে ইসলামি ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়- ইন্দোনেশিয়া থেকে মিশর। গত কয়েক বছর ধরে গণতান্ত্রিক পশ্চিমি দুনিয়া মানবাধিকার ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে যেভাবে মোদি সরকারকে সমালোচনাবিদ্ধ করে চলেছে, তার তীব্রতা বাড়বেই শুধু নয়, এবার তারা বলতে পারবে, এতদিন তারা বাড়াবাড়ি কিছু করেনি। বলেওনি। তাদের কোনও অভিযোগই মিথ্যা ছিল না।
[আরও পড়ুন: আত্মনির্ভরতা কোন পথে, শুধু সুদ বাড়িয়ে কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম রিজার্ভ ব্যাংক?]
হজরত মহম্মদকে নিয়ে বিজেপির দুই নেতা-নেত্রী নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দলের কটূক্তি কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাত নয়। নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসা-ইস্তক বিজেপির শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয়ে দেশে উগ্র-হিন্দুত্ববাদের প্রসার যেভাবে ঘটে চলেছে, সংবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে ঘৃণার বীজ যেভাবে বোনা হয়েছে, তাতে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঘটনাক্রম এক-এক করে বিচার করুন।
রাম মন্দির আন্দোলন দিয়ে শুরু। তারপর গোরক্ষা নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে কড়াকড়ি, বাড়াবাড়ি, গণপিটুনি, হত্যা। এল ধর্মান্তর নিয়ে কঠোরতা। লাভ জিহাদ। রোমিও পুলিশ। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি রূপায়ণের ধাপ হিসাবে এল ‘তিন তালাক’ নিষিদ্ধ আইন। তোষণহীন নীতি প্রতিষ্ঠায় ইদানীং মাথা তুলেছে তিনটি নতুন ইস্যু- হিজাব-হালাল-আজান। ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’ স্লোগানকে পরিহাস করে সমান্তরালভাবে চলছে হিজাব-পরিহিত মুসলিম নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখার অপচেষ্টা। মুসলমান দমনের নামে হিন্দুত্ববাদীদের ধর্ম সংসদ থেকে দেওয়া হল গণহত্যার নিদান। বুক বাজিয়ে বিজেপির সগর্ব ঘোষণা– মুসলমানদের ভোট ছাড়াই তারা ক্ষমতা আদায় করতে পারে। শুরু হল ৮০-২০ সংঘাত। আমদানি হল ‘বুলডোজার’ সংস্কৃতি। আমিষ বন্ধের অভিযান। জমতে থাকল ‘দেশদ্রোহ’-র অপরাধে মামলার পাহাড়। শুরু হল মসজিদে-মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজার প্রতিযোগিতা। মন্দির-মসজিদ বিতর্ক উসকে দিতে নিম্ন আদালতে রুজু হতে থাকল মামলা। হিন্দুত্বের দোহাই দিয়ে যদি যা খুশি তাই করে পার পাওয়া যায়, আইন যদি হয় অন্ধ, শীর্ষ নেতৃত্ব ধৃতরাষ্ট্র। দাঙ্গাকারীদের রক্ষায় নেতারা যদি ঢাল হয়ে দাঁড়ান, বেপরোয়া ও দুঃসাহসী হয়ে ওঠাটাই তো তখন স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে। নূপুর-নবীন এমনি এমনি সাহসী হননি!
নূপুরের কুকথার উদ্গিরণ একসপ্তাহ আগে। নবীনের নোংরা টুইট তার পর। দেশে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ হচ্ছিল। নূপুরের বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশে দাঙ্গা শুরু হয়। কিন্তু এতদিন কিচ্ছুটি করেনি সরকার ও দল। বিজেপির কোনও নেতা রা কাড়েননি। একজনও তিরস্কার করেননি। কেউ বলেননি, ওই মন্তব্য দলের নয়। দল অনুমোদন করে না। সরকারও বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী যথারীতি বোবা-কালা সেজে থেকেছেন। টনক নড়াল কাতার। ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে যেই রক্তচক্ষু দেখাল, যেই বলল ভারতকে ক্ষমা চাইতে হবে, যেই সেই সুরে সুর মেলাল সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ইরান- দেখা গেল বিবৃতির বহর। রাতারাতি বরখাস্ত হলেন নবীন। সাসপেন্ড হলেন নূপুর। সরকার বলল, ভারত সব ধর্মকে সমান চোখে দেখে। সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
এত দিন ধরে ভিনদেশি সমালোচনা সত্ত্বেও যে-সরকার বিচলিত বোধ করেনি, হঠাৎ তারা কেন নিজেদের ধর্মীয় বোধ ও নীতি প্রতিষ্ঠায় এমন মরিয়া? কারণ, শাসক দলের নেতারা লক্ষ্মণরেখা টপকেছেন। হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কটূক্তি সরকারের সব প্রতিরোধ খানখান করে দিয়েছে। ইসলামি দুনিয়া যেভাবে ও যে ভাষায় ভারতের সমালোচনা করেছে, ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে, কোনও যুক্তিতেই তা উপেক্ষা করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। সংখ্যালঘুদের প্রতি আক্রমণের সব ঘটনা এতদিন ভারতের চোখে ছিল ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। এই সংক্রান্ত বিদেশি আলোচনা ও সমালোচনা ছিল ‘অনধিকার চর্চা’। এই প্রথম সেই যুক্তি ছাপিয়ে মোদির ভারত ‘বেনাকাব’ হয়ে গেল। যে-দেশের শাসকদলের নেতারা অন্য ধর্মের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাহীন, সেই দেশের সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতন ও অধিকার হরণের দায়ে অভিযুক্ত হলে, তা অবিশ্বাস ও অস্বীকার করা কঠিন। যেমন কঠিন, সেই সমালোচনা ‘আন্তর্জাতিক ভোট ব্যাংকের রাজনীতি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া। এই প্রথম নিজের পাতা ফাঁদে পড়ল বিজেপি।
মোদি সরকারের হেঁটমুণ্ড ও বিচলিত হওয়ার কারণও আছে। বিদেশ মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রবাসী ভারতীয়র সংখ্যা কম-বেশি ১ কোটি ৪০ লক্ষ। এর মধ্যে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান ও বাহরিনেই বাস ৮৯ লাখের। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে এই সমস্ত দেশ থেকে প্রবাসী ভারতীয়রা পাঠিয়েছে ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শকাতর মন্তব্য মুসলিম দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কহানির কারণ হলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। ‘ব্যাকল্যাশ’ হওয়ার আশঙ্কায় কুয়েতের বাজার থেকে ইতিমধ্যেই ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ভারতের মোট জ্বালানির ৬২ শতাংশ রপ্তানি করে পশ্চিম এশিয়া। তারা ‘দুর্বিনীত’ ভারতকে ‘শাস্তি’ দিলে তার প্রভাব হবে মারাত্মক।
ঠেলার নাম বাবাজি। মোদি সরকার এমনি এমনি নড়েচড়ে বসেনি। রাজনীতিবিদদের অকাজের দায় সামলাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে কূটনীতিকদের। সাম্প্রদায়িকতা ও পরধর্ম অসহিষ্ণুতার যে-ঝলক শাসকদলীয় দুই নেতা দেখালেন, তার প্রতিক্রিয়া কাশ্মীরকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সেটা দেখার। কাশ্মীরে মোদি সরকার এই মুহূর্তে ব্যাকফুটে। সরকারকে চাপে ফেলে দিয়েছেন তাঁরা, এত বছর বিজেপি যাঁদের শোকেস করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ছড়ি ঘুরিয়েছে। কাশ্মীরি পণ্ডিত সমাজ। এঁরাই এখন মোদি সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রমাগত পণ্ডিত হত্যা বানচাল করে দিচ্ছে সরকারের যাবতীয় পরিকল্পনা। নিরাপত্তার অভাবে সংগত কারণে পণ্ডিতরা জম্মু চলে আসতে চান। এতে সায় দিলে মোদি সরকারও পণ্ডিত বিতাড়নের দায়ে অভিযুক্ত হবে। প্রমাণ হবে, উপত্যকা যে তিমিরে ছিল সেখানেই আছে। আবার, পণ্ডিতদের জোর করে ধরে রাখা হলে পরবর্তী প্রতিটি হত্যার জন্য সরকারকে দোষের ভাগীদার হতে হবে। পণ্ডিত-হত্যার প্রভাব পড়েছে জম্মুতেও। ক্ষোভ-বিক্ষোভ বেড়ে চলেছে। প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ সত্ত্বেও কাশ্মীর অপরিবর্তিত। মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতি উপত্যকার চালচিত্র নতুন করে আঁকতে ব্যর্থ। পণ্ডিতরা এখন বিজেপির ‘শাঁখের করাত’।
নির্বাচনী কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস ও জনবিন্যাসে বদল ঘটিয়ে মুসলমান প্রধান কাশ্মীরে জম্মুর কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্য দিয়ে হিন্দু সরকার গঠনের লক্ষ্যে সরকার এখনও অবিচল। অস্থিরতা জিইয়ে রেখে তা করতে গেলে মুসলিম দুনিয়ার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, পশ্চিম এশিয়ার সমস্বর প্রতিবাদ তার একটা ইঙ্গিতবাহী। নির্বাক প্রধানমন্ত্রীর বোঝা প্রয়োজন, বোবা-কালারা শত্রুহীন হতে পারে, কিন্তু বিপন্মুক্ত কখনও নয়।