দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িতে পৃথা চক্রবর্তীর ছবি ‘ ফেরা ‘ -র শুটিং চলছিল । ‘আঁখো দেখি’ , ‘মাসান’ , ‘কাম্য়াব’, ‘বধ’ খ্যাত অভিনেতা সঞ্জয় মিশ্রর প্রথম বাংলা ছবি । সহ অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী তাঁর ছেলের চরিত্রে , সোহিনী সরকার বাড়িওয়ালি । দুপুরবেলায় লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলতে রাজি হলেন । ঘি ভাত , লেবু আর দই ছাড়া কিছু খাবেন না । ‘কাজের মধ্যে আছি , বেশি খিদে নেই', বলে হাসলেন অভিনেতা। সাক্ষাৎকারে বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
সঞ্জয় মিশ্র এবং সোহিনী সরকার
এই তো কিছুদিন আগে বড় পর্দায় ‘দিল সে’ দেখতে গিয়ে আপনাকে দেখলাম , কত কম বয়স তখন , কেরিয়ারের শুরুর দিকে , ছোট্ট চরিত্র…
হ্যাঁ , মনি রত্নমের জন্যই ছবিটা করেছিলাম । কিছু পরিচালক থাকেন যাদের না করা যায় না , যত ছোটই চরিত্র হোক না কেন ! । মনি রত্নম যেমন । আপনি তবলা বাদক, যদি রবিবসংকরের সঙ্গে না বাজান তাহলে আর কি হল ! যদি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ না করেন ! তেমন আর কি ! আমাকে একজন বলল টেরোরিস্টের চরিত্রের জন্য লাগবে । মুম্বইয়ের হোটেলে দেখা করলাম।পাশে একজন বসে ছিলেন ।মণি স্যার বললেন একে চেনো ? আমি ভাবলাম হবে কোনও অ্যাসিস্টেন্ট! তিনি রামগোপাল বর্মা ! চিনতে না পেরে লজ্জায় চলে যাচ্ছি , রামগোপাল বললেন , আমি একটা ছবি করছি ‘সত্য’, তুমি করবে ? কী সব দিন ছিল । ‘দিল সে’-র স্মৃতিও মনে পড়ে । অসম্ভব ভালো মিউজিক । ‘ছাইয়া ছাইয়া’ তো একটা অন্য দিক খুলে দিল । আমার গান নয় কিন্তু ওই গানে আমিও ঢুকে পড়েছিলাম । ট্রেনের একেবারে সামনে দিকে বসেছিলাম । গাছের বড় ডালপালা এলে আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম ।
সেই শাহরুখের প্রযোজনাতেই কাময়াব। যেভাবে ছোট , এক্ট্রা রোলে অভিনয় করে আপনার উত্থান, তেমন অভিনেতাকে নিয়েই তো এই ছবি !
শাহরুখের ভালো স্ক্রিপ্ট চেনার চোখ আছে । এই ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কেরিয়ারে। মনে হয় যেন নিজের কেরিয়ারের গল্পে নিজেই অভিনয় করেছি । আমি বেশ কিছু ভালো পরিচালক আর প্রযোজক পেয়েছি যারা আমাকে অন্য ধরনের কাজের সুযোগ দিয়েছেন । সব সিনেমা তো আর বিজনেস দিয়ে ভাবলে হয় না , সিনেমার জন্য প্যাশন চাই ।
আপনি তো কেরিয়ারের শুরুতে আর্ট ডিরেক্টরেরও কাজ করেছেন !
হ্যাঁ, করেছি । সিনেমা ভালবাসি , সেই সংক্রান্ত যা বলবে করে দেব। ক্যামেরাম্যানও হয়ে যেতে পারতাম । মনে আছে একেবারে শুরুর দিকের কথা। তিগমাংশু ধুলিয়া এনএসডি- তে আমার ব্যাচমেট ছিল।ও একটা টিভি সিরিজ করছিল ‘ হম বোম্বাই নেহি জায়েঙ্গে ‘। ইরফান ভাই থে উসমে । এনএসডি- র সব অভিনেতারা । তিগমাংশু বলল, মিশ্র তু কুছ কর দে ! আমিও আর্ট ডিরেক্টর হয়ে গেলাম । তখন আর্ট ডিরেক্টরকে ,সেটিং বলা হত! জীবনে অনেক অভিনয় করে নিয়েছি । প্রথমে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় । তারপর সমাজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় । তারপর বোধহয় নিজের জন্য কাজ করতে হয় । শুধুই কমেডি অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে চাই না । কাদের খানকে মনে আছে ! বড় অভিনেতা কিন্তু শুধুই কমেডিতে আটকে দেওয়া হল । এখানে কমেডি মানে তো শুধু বকবক! যখন আঁখো দেখি অফার করা হয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম । তারপর সিনেমা স্ক্রিনিং-এর পর নানা মানুষ এসে কথা বলছে । বলছে ,আমার চাচাজি আপনার মত ছিলেন, একটু জড়িয়ে ধরব! ছবিটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল । আঁখো দেখির মত ছবি হল টেস্ট ম্যাচ , আর মেনস্ট্রিম কমেডি হল টি-টোইয়েনটি!
কীভাবে প্রভাবিত করেছিল ?
সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আমার দাদি অসুস্থ হওয়ার সময় ।তখন কারও সঙ্গে কথা বলছি না । হাসপাতালে একজন প্রায় মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখলে আমরা বাইরে থেকে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি , সে কি ভাবছে বোঝার চেষ্টা করি না ।দাদি এক সুগন্ধি তেল মাখতেন । সেটা খুঁজে এনে একদিন লাগিয়ে দিলাম । দাদির ফোকলা দাঁতে হাসি ফুটল । জীবনকে দেখার চোখ বদলে যায় ।
জীবনের সঙ্গে কী সেটিং আপনার ?
ব্যস ,বেঁচে থাকতে চাই । এই কয়েকদিন এত সুন্দর কাটালাম ।কলকাতায় এসে খুব খুশি হয়েছি। আমার জন্ম পাটনাতে হলেও , বাংলার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। বাবার বদলির চাকরি ছিল। আমি তখন খুব ছোট। এসেছিলাম কলকাতায়। তারপর বেনারস বদলি হয়ে গেল। আমার কলকাতা কানেকশন আছে। বাড়িতে ফোন করেছিলাম ধর্মতলা থেকে , মা শুনেই বলল এখানে কেসি দাসের মিষ্টির দোকান আছে , বলে দিল কি মিষ্টি খেতে হবে । ঝর্ণা ঘি দিয়ে গোবিন্দভোগ, বড়ি, চচ্চরি, কচু বাটা— এসব প্রিয় খাবার। ধর্মতলায় এসে প্রেস ব্যুরোর অফিসের সিড়িতে বসে বিড়ি খেলাম , বাবা নিশ্চয়ই এখানে বসে সেটাই করেছিলেন ! এখান থেকে বাবা পাটনা গেলে বাবা কেসি দাস থেকে মিষ্টি নিয়ে যেতেন ! বাবা সরোদ বাজাতেন , শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাবার গুরু ছিলেন ।আলাউদ্দিন খাঁ এর শিষ্য জ্যোতিন ভট্টাচার্য আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন । যেদিন বাবা চলে গেলেন , বুঝলাম এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ জীবনে আর নেই !
আপনি জানেন , এর মধ্যে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি দেখানো হল !
তাই নাকি ! আমার খুব ইচ্ছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বড় পর্দ্যায় দেখার । ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আর ‘জলসাঘর’ -এর ভিনাইল রেকর্ড যদি পাওয়া যেত! এই ছবির সংগীত! ভাবা যায় না ! এখানে পাওয়া যাবে?
সেটা বলা মুশকিল ! আচ্ছা বাংলা ছবি করতে রাজি হলেন কেন ?
পরিচালক পৃথা চক্রবর্তীর মূল্যবোধ আমার সঙ্গে মেলে । বহত সমঝদার হ্যায় পৃথা । প্রথম যেদিন নার্ভাস হয়ে কাপতে কাপতে এল অফিসে দেখা করতে , বললাম আগে বাড়ি এস, মাছ ভাত খাও তারপর কথা হবে । পান্নালালের চরিত্রের সঙ্গে রিলেট করতে পারি ।আর আমি ভয়ে ভয়ে কলকাতা এসেছিলাম , এখানে অভিনয়ের ধারা নিয়ে আমার ভুল ধারণা ছিল । কিন্তু সোহিনী আর ঋত্বিককে দেখে বুখলাম ওরাও আমার স্কুল অফ অ্যাকটিং-এই বিশ্বাসী । আর ঋত্বিক তো দারুণ অ্যাক্টর , বলা ভালো রিয়াক্টর !
সঞ্জয় মিশ্র ও ঋত্বিক চক্রবর্তী
যদি ফিরতে পারতেন?
আমার শৈশবে ফিরতাম । যেখানে এই কলকাতার মত খড়খড়ি দেওয়া জানলা আছে , বেনারস , ছোটবেলা , পাপা কা ঘর ! মুম্বইয়ের কংক্রিটের বিল্ডিং থেকে ডেডবডি বেরনোতে আমি উৎসাহী নই । লোনাভলার গ্রামে আমার একটা ফার্মহাউজ আছে , সেখানে এবার নবরাত্রির সময় গিয়েছিলাম । প্রথম দিন ভোরবেলায় মহালয়া চালিয়ে দিয়েছিলাম । আগে আমাদের মেরে ধরে ঘুম থেকে তুলে দিত বড়রা মহালয়া শোনার জন্য । এখন আর কেউ এসব শোনে না ! এই কলকাতা থেকে চলে যাব , অন্য কাজ শুরু করব , এই ছবির পান্নালাল মরে যাবে ।
শুটিংয়ে ব্যস্ত সঞ্জয় মিশ্র
সম্প্রতি একটি ছবির প্রচারে মহিমা চৌধুরীর সঙ্গে আপনার ছবি শোরগোল ফেলে দিল!
আর বলবেন না । আজকাল প্রচারের নানা ঢং! আমার মায়ের কাছে কত ফোন এসেছে ভাবতে পারবেন না । তারা ফোন করে বলছে , কী দরকার ছিল সঞ্জয়ের এসব করার, বাড়িতে ওর দু-দুটো বড় মেয়ে , ছি ছি ! ( হাসি )
