‘কান’-এ গ্রাঁ প্রি জয়ী ছবি ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট’ শহরে মুক্তির পর এসেছিলেন পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া। মুখোমুখি বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
পায়েল, কলকাতায় আপনাকে পেয়ে ভালো লাগছে। ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট’ ছবিতে মুম্বই প্রধান চরিত্র। এই শহরকে বৈপরীত্যের লেন্স দিয়ে দেখেছেন আপনি। আপনার সঙ্গে এই শহরের সম্পর্ক কেমন?
পায়েল: ঠিকই বলেছেন। আমার কাছে মুম্বই মানে পরস্পরবিরোধী একটা শহর। এই শহর যেমন প্রচুর সুযোগ করে দেয়, পে-স্কেল বেটার। অল্পবয়সিদের এক ধরনের স্বাধীনতা দেয়, কারণ কেউ কাউকে চেনে না, নিজের মতো করে বাঁচা যায়। এই ‘অ্যানোনিমিটি’-এক ধরনের স্বাধীনতা দেয়। ঘরভাড়া, ডেলি প্যাসেঞ্জারি, সবটাই খরচসাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষ। জটিল শহর। আমার জন্ম এখানে হলেও, বারবার শহর ছেড়ে অন্যত্র গিয়েছি-ফিরেছি। এই আসা-যাওয়ার ফলে পুরোপুরি মুম্বইকর নই। খানিকটা বহিরাগত তো বটেই। তাই এই শহরকে খানিকটা দূর থেকে দেখতে পারি। একটা পারস্পেকটিভ তৈরি করতে পারি। এই শহরের চরিত্র বদলাতে দেখেছি আমি। প্রচুর ডেভলপমেন্ট হয়েছে কিন্তু সেটা হয়েছে এখানকার পুরনো, তুলনামূলক অস্বচ্ছল মানুষদের উপড়ে দিয়ে এবং ধনী ব্যবসায়ীদের বাড়বাড়ন্তর ফলে। আগে প্রচুর মিল ছিল, পাবলিক স্পেস একেবারে সাধারণ মানুষদের নাগালে ছিল। অগুনতি স্কাইস্ক্র্যাপার এবং প্রচুর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আগমনে আগেকার স্বাভাবিক জীবন বদলেছে।
পোলারাইজড হয়েছে আগের থেকে!
পায়েল: একেবারেই তাই। আর সেটা আমার একটা অস্বস্তির জায়গা। কারণ এখন মানুষ ওই তুলনামূলক অস্বচ্ছল মানুষের যাপন, উপস্থিতি আর দেখতে চায় না, মানতে চায় না। সি-লিংক ধরে অফিস, দামি কফিশপে আড্ডা, আর নিজের বহুতল বাড়ির ‘বাবল’-এর বাইরে দেখতে চায় না। মুম্বইয়ে এটাই গ্রোথ। এই অসাম্য খুব বেশি করে ভাবিয়ে তোলে। আমার ছবিতেও সেটাই ধরার চেষ্টা করেছি।
আপনার ছবির মেকিংয়েও একটা পরস্পরবিরোধী ব্যাপার আছে। খানিকটা নন-ফিকশন ডকু স্টাইলে, তারপর গল্পে ঢুকে পড়া। ছবির দৃশ্য এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকেও কনট্রাস্ট আছে, বিশেষ করে পিয়ানো পিসটা।
পায়েল: পিয়ানো পিসটা নিয়ে বলতে চাই। অনু এবং সিয়াজের প্রেমের কথা ভেবে ওটা করা। যখন মানুষ প্রেমে পড়ে, তখন চারপাশ যতই মলিন হোক, যতই না-পাওয়া থাক, ভিতরে একটা ফুর্তি থাকে, প্রফুল্লতা থাকে। ঘ্যানঘেনে বাস-বা ট্রেন জার্নিও সুখের হয়, এই ফিলিংটা ধরার জন্য এই পিয়ানো পিসটা ব্যবহার। যেটার মধ্যে একটা ‘এক্সট্যাসি’ আছে। এটা একজন ইথিওপিয়ান নানের কমপোজ করা। গত বছর তিনি মারা গিয়েছেন। ওঁর নাম এমা হোয়ে সেগে মারিয়ম গাবরু। ওঁর এই সুর ছবিতে মোটিফের মতো ব্যবহার করেছি।
সলিল চৌধুরীর গান শোনা গিয়েছে ছবিতে...
পায়েল: হ্যাঁ, রান্নাঘরের দৃশ্যে ব্য়বহার করেছি। যেখানে প্রভা গান শুনছে। আসলে আমি সলিল চৌধুরীর সুরের খুব বড় ভক্ত। বিশেষ করে মালায়লম ছবিতে ওর সঙ্গীত অনবদ্য।
ছবির শুরু ডকু স্টাইলে উদ্বাস্তু মানুষদের ভয়েস ওভার দিয়ে। এখনকার হিন্দি ছবিতে এই মানুষদের আর সেভাবে পাই না।
পায়েল: এই শহরটা তৈরিই হয়েছিল স্থানান্তরিত মানুষদের নিয়ে। ‘কোলি’ জনজাতিরা এখানকার। ব্রিটিশরা কমার্শিয়াল পোর্ট হিসাবে এই শহর স্থাপন করে। এই যে নানা শহর থেকে মানুষ এসে মুম্বইয়ে থেকে গিয়েছে সেটাই শহরের চরিত্রকে তৈরি করেছে। আর এটাই আমাদের মিশ্র আইডেনটিটি। তাই ভয়েস ওভারে, বাঙালি, গুজরাতি, মারাঠি, তামিল, মালয়ালি– সব ধরনের মানুষের কথা আছে। নিজের দেশ ছেড়ে আসার বিরহ এবং নতুন জায়গাকে নিজের দেশ বানিয়ে তোলা– এটা আমাদের বাড়িতে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় ছিল। তাই মাইগ্রেশন নিয়ে আগ্রহ আমার আছে।
মুম্বইয়ের প্রেক্ষাপটে তিন নারীর গল্পের ভাবনাটা কীভাবে এল?
পায়েল: এমন একটা ছবি করতে চেয়েছিলাম যেখানে মুম্বই শহরের প্রেক্ষাপটে একটা বন্ধুত্বের গল্প থাকবে। মুম্বইয়ে শিফট করলে রুম শেয়ার করতে হয়। সেই রুমমেট পছন্দের নাও হতে পারে। অনু এবং প্রভার মধ্যে সেই শহুরে বন্ডিং রয়েছে। অন্যদিকে পার্বতী মারাঠি, যে হিন্দি বলে। মুম্বই শহর ছাড়া একজন মারাঠি মহিলার অন্য মালয়ালির সঙ্গে আর কোথায় বা দেখা হবে! সব বড় শহরেই এমন ইন্টারসেকশন আছে।
‘আলো’ শব্দটা ছবির টাইটেলেই রয়েছে। আপনি কেমন আলো খেঁাজেন নিজের জীবনে?
পায়েল: হ্যাঁ, আলো, আমরা সকলেই খুঁজি। ‘হোপ’ ছাড়া বাঁচা যায় না। আমার কাছে হোপ বা আশার আলো হল বন্ধুরা যারা পরিবারের মতোই। আই হ্যাভ ফাউন্ড মাই ফ্যামিলি ইন দ্য ফিল্ম পিপল উইথ হুম আই ওয়র্ক। তারা সবসময় সাপোর্ট করে। জন্মগত সূত্রে পরিবারের সদস্য যেমন বাবা, মা– এই সম্পর্কগুলো খুব কোডেড। ব্যাগেজ নিয়ে আসে। বন্ধুত্বে কোনও ব্যাগেজ থাকে না। তাই সেটাই আমার কাছে আলো। উই ক্যান সারপাস আওয়ার আইডেনটিটি উইথ ফ্রেন্ডশিপ, এমপ্যাথি।
ছবিতে বিভিন্ন বয়সের নারী এবং তাদের জীবনের ঝলক দেখি।
পায়েল: হ্যাঁ, নারীর জীবনের ক্রোনোলজি বিভিন্ন বয়সের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলাম। গোড়ায় দেখি একেবারে বয়স্ক মহিলা যে তার বরকে দেখতে পায়। তারপর অনু, প্রভা, পার্বতী। এবং একেবারে শেষে সমুদ্রের ধারে দোকানে সেই অল্পবয়সি মেয়েটাকে নাচতে দেখি। যেন এক নারীর জীবনের নানা পর্যায়, আর এই অল্পবয়সি মেয়েটাকে দেখলে বুঝতে পারি, এটা কনটিনিউ হবে। পরের প্রজন্মের অাভাস। বিভিন্ন নারীর, তাদের ভিন্ন মতাদর্শ এবং তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ চেয়েছিলাম। এদের প্রত্যেকের জীবনে পুরুষ আসে, যায়– যাদের তারা যে সবসময় চায় এমন নয়। কখনও চায়, পায় না, কখনও চায় না তবু ফিরে-ফিরে আসে। পার্বতীর ক্ষেত্রে মৃত স্বামীর উপর সে বীতশ্রদ্ধ। এই পুরুষদের স্মৃতি, উপস্থিতি কীভাবে ধরে রাখবে, কতটা ছেড়ে দেবে– সেটাও ছবির একটা জায়গা।
আপনার দিদা কলকাতায় এসেছিলেন পার্টিশনের সময়। কলকাতার সঙ্গে একটা যোগ আছে...
হ্যাঁ, এই ছবিতে বৃদ্ধার চরিত্রটা আমার দিদার থেকে অনুপ্রাণিত। আমার দিদা মারা যায় ৯৮ বছর বয়সে। তার স্বামী মারা যায় তখন তার ৫৫ বছর বয়স। অনেকটা সময় দিদা একাই কাটিয়েছেন। শেষের দিকে স্মৃতির সমস্যা হত। তখন বলেছিলাম ডায়েরি লিখতে। সেখানে দেখতাম প্রায়ই স্বামীর কথা লিখছেন। আমার িদদা বিবাহিত জীবনের চাইতেও বেশি সময় সিঙ্গল ছিলেন, তবু স্বামীর স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। স্বামীকে যে পছন্দ করতেন তাও না। আমাদের জীবনে এমন অনেক সম্পর্ক থাকে যেগুলো পিছু ছাড়তে চায় না। পার্বতীর সেই পিছুটান নেই। আর হ্যঁা, দিদা সবসময় কলকাতার কথা বলত। কলকাতায় তার স্বামীর চাকরি হয়েছিল। রাসেল স্ট্রিটে থাকতেন। যেহেতু সেই প্রথম করাচির শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে দিদা ছিলেন, তাই এই শহরটাই তঁার কাছে স্বাধীনতার অন্য নাম। মেট্রো সিনেমায় গিয়ে দিদা ‘লরেল হার্ডি’ দেখেছেন। গাড়ি নিয়ে দিদা একা একা ঘুরতেন। তিনি মুম্বই শিফট করতে চাননি।
আপনার আগের ছবি দেখিনি, কিন্তু এই ছবিটা দেখে মনে হয়, খুব ব্যক্তিগত জায়গা থেকে ছবিটা তৈরি করা।
পায়েল: আসলে আমার নিজের কিছু প্রশ্ন ছিল, সেগুলো খুঁজতে চেয়েছি। যেমন আমরা কোনও মানুষের সঙ্গে যে নির্দিষ্ট ব্যবহার করি, সেটা কেন করি? যখন ছবিটা লিখতে শুরু করি, আমি অনুর বয়সের কাছাকাছি ছিলাম। লিখতে লিখতে প্রভার বয়সের কাছাকাছি পৌঁছলাম। প্রথমে অনুর দিক থেকে প্রভাকে দেখলে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু পরে প্রভার সঙ্গে বেশি রিলেট করতে পেরেছি। এখনকার প্রজন্মকে পুরোপুরি বুঝি না মনে হয় এখন। আমি জাজ করে ফেলি। পরমুহূর্তেই মনে হয়,Payal Kapadia জাজ করা ঠিক নয়। এটা কোথা থেকে আসছে? ঈর্ষা থেকে? এই সেলফ রিফ্লেকশন আমি চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে খেঁাজার চেষ্টা করেছি।
অনু এখানে সবচেয়ে ফ্রি স্পিরিটেড, ওর নিজের একটা এজেন্সি আছে। অন্তর্বাস খোলা এবং না-খোলার দৃশ্যটা আমার কাছে খুব উল্লেখযোগ্য।
পায়েল: হ্যাঁ, আমি অনুকে একটা এজেন্সি দিতে চেয়েছিলাম। প্রভাকে টিজ করার জন্য ওর সামনেই অন্তর্বাস খুলে ফ্যালে। কারণ অনুও বোঝে, নার্স হলেও (যার কি না মানুষের শরীর নিয়েই কাজ) প্রভা শরীর নিয়ে লাজুক। অন্যদিকে প্রেমিকের সঙ্গে আদরের সময় অন্তর্বাস খোলে না কারণ সিম্পলি অনুর ইচ্ছে করেনি। এবং এতে দুই নারীর টেমপারামেন্টও ধরা পড়ে।
আপনার তিন অভিনেত্রী যত প্রশংসাই করি কম হবে...।
পায়েল: আমি খুব লাকি ওদের পেয়ে। আসলে অভিনয় করে চলে যাবে এমন অভিনেতা আমি চাইনি। গল্প, ছবির পলিটিক্স নিয়ে এনগেজ করতে চাইবে তেমন অভিনেতাই চেয়েছিলাম। দে আর অল ভেরি স্ট্রং ফায়ারি উইমেন। ওহ মাই গড! খুব ইন্সপায়ারিং। তাদের জীবনচর্চাও আমার কাছে শিক্ষনীয়। এটা প্রত্যেককে নিয়ে কোলাবোরেটিভ প্রসেস ছিল। থিয়েটার করার মতো অনেকটাই। কানির কাজ আমি দেখেছি। ছায়া কদমের ‘ফ্যানড্রি’ দেখে ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম।
আপনার ছবিতে বাঙালিরাও কাজ করেছেন।
পায়েল: হ্যাঁ, ছবির ডিওপি রণবীর দাস এবং ওর ভাই তোপসে যে এই ছবির মিউজিক ডিরেক্টর– ওরা দুজনেই কলকাতার। জিকো ছবির কো-প্রোডিউসারও কলকাতার। আর এফটিআইআই-এর থার্টি পারসেন্ট বাঙালি, সবাই কলকাতার না হলেও (হাসি)।