বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতবর্ষে মহিলা ক্রিকেটের নবজাগরণ হয়েছে। দেশের সর্বত্র সমাদৃত হচ্ছেন হরমনপ্রীত কৌর-স্মৃতি মান্ধানা-রিচা ঘোষরা। সংবর্ধনার পর সংবর্ধনা চলছে তাঁদের। কিন্তু কেমন ছিল দেশে মহিলা ক্রিকেটের প্রথম সব কিছু? কলম ধরলেন রাজু মুখোপাধ্যায়। আগামী পর্বে সমাপ্য।
বিগত কয়েক দিন ধরে আমি উত্তরবঙ্গে রয়েছি। শিলিগুড়িতে থাকাকালীন, বিশ্বজয়ী বাঙালি ক্রিকেটার রিচা ঘোষ নিজের জন্মশহরে ফিরেছিল। দেখেছি, কী পরিমাণ হইচই-উৎসব চলছিল ওকে ঘিরে। দেখছিলাম যত, ভালো লাগছিল। এই প্রথম বাংলার কোনও প্লেয়ার ক্রিকেট-গোল্ড নিয়ে এল বিশ্বকাপ থেকে! এর আগে সিনিয়র পর্যায়ে বাংলার পুরুষ বা মহিলা– কোনও ক্রিকেটারই যা করে দেখাতে পারেনি। এক কথায়, অনবদ্য কীর্তি। চিরকাল ভারত ও বাংলার ক্রিকেটে রিচার নাম স্বর্ণাক্ষরে থেকে যাবে।
সময়-সময় ভাবি, কী প্রাণপণ লড়াই-ই না লড়তে হয়েছে রিচাকে! উত্তরবঙ্গের মেয়ে। শিলিগুড়ির মেয়ে। যতটুকু যা সুযোগ পেয়েছে, সে সবকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজয়ী হয়েছে। আমি বিশেষ করে সাধুবাদ জানাব ওর বাবা-মা’কে। সাধুবাদ জানাব, রিচার ক্রিকেট কোচদের। যাঁরা নিরন্তর ওকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। পরিষ্কার লিখছি, রিচা অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেল বাংলার ক্রিকেটকে।
কেন জানেন? আসলে কেউ যদি কম বলে বেশি রান করে দেশকে ম্যাচ জেতায়, তার গুরুত্ব আলাদা। রিচা যেটা বিশ্বকাপে বারবার করে গিয়েছে। সব সময় দেখবেন, ও কম বল খেলে বেশি রান করছে। ক্রিকেটে যাদের বলে ফিনিশার। একটা সময় অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল বিভানকে যা বলা হত, ভারতের মহেন্দ্র সিং ধোনিকে যা বলা হত। তবে মুশকিল হল, ভারতবর্ষ সংখ্যাপ্রিয় দেশ। আমরা ক্রিকেটারের ম্যাচ জেতানোর ইনিংসের চেয়ে বেশি দাম দিই সংখ্যাকে। কে ক’টা সেঞ্চুরি করল, কে কত রান করল, সে সমস্ত দেখি। কিন্তু লোয়ার অর্ডারে নেমে কম বলে বেশি রান প্রতিনিয়ত করে যেতে কলজে লাগে। যা রিচা করে দেখিয়ে দিয়েছে। অনেক বড় কথা বলে ফেলছি হয়তো। কিন্তু আমার মতে রিচা যা করেছে, তা পৃথিবীর অনেক ক্রিকেটার করতে পারেনি। পারবে না।
রিচাকে নিয়ে সর্বত্র প্রচুর লেখাপত্র দেখছি। তাই বেশি আর আমি লিখছি না। বরং আমাদের দেশের মহিলা ক্রিকেটের প্রাণপ্রতিষ্ঠার নেপথ্যে বাংলার কতটা অবদান ছিল, সেটা বলি।
ভারতবর্ষে প্রথম মহিলা ক্রিকেটারদের সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে। যে সংস্থার পোশাকি নাম ছিল আইডব্লিউসিএ। ইন্ডিয়ান উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। লখনউয়ে জন্ম নিয়েছিল সে সংস্থা। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই বা চেন্নাইয়ে নয়। ইন্টারেস্টিং হল, মিসেস গান্ধীর আশীর্বাদ না থাকলে আইডব্লিউসিএ সৃষ্টিই হত না! মিসেস গান্ধী মানে, ইন্দিরা গান্ধীর কথা বলছি। সালটা আগেই লিখেছি। ১৯৭১ সাল। সবেমাত্র পাকিস্তানকে দু’ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। মিসেস গান্ধী সেই সময় যেখানে হাত দিচ্ছেন, সর্বত্র সোনা ফলছে। উনি ভীষণভাবে চেয়েছিলেন, দেশের মহিলারা সার্বিকভাবে এগিয়ে আসুন। সব ক্ষেত্রে। অতএব, আজকের ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের উত্থানের নেপথ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদান ভুললে চলবে না। উনিই প্রথম, যিনি কি না ভারতে মহিলা ক্রিকেটের প্রচলন করতে চেয়েছিলেন।
দেখুন, আমরা রাজনীতিবিদদের বেশিরভাগ সময়ই সমালোচনা করি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা চাইলে অনেক কিছু সম্ভব। অনেক ভালো কিছু সম্ভব। মিসেস গান্ধীকে উদ্যোগী হতে দেখে বাংলায় এগিয়ে আসেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তিনি বলে দেন, সিএবিতে মহিলা ক্রিকেট শুরু করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে। ফেলে রাখলে চলবে না। তৎকালীন সিএবি কর্তারা যা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। মহিলারা ক্রিকেট খেলবেন, সেই সময় যে কল্পনার অতীত!
একজনের কথা এখানে না বললেই নয়। কালীঘাট ক্লাবের নতু কোলে। নতুবাবু অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। লোকের উপকার ছাড়া তাঁকে আর কিছু করতে দেখিনি। তিনিই সর্বাগ্রে ঘোষণা করেন যে, কালীঘাট ক্লাবে প্র্যাকটিস করবেন বাংলার মহিলা ক্রিকেটাররা। ওঁরা করবেন ভোরে। আমি, গোপাল (গোপাল), পলাশ (নন্দী), অর্থাৎ ছেলেদের টিমটা ট্রেনিং করবে দুপুরে। নতুবাবু মহিলা টিমের কোচ নিয়োগ করেন প্রদ্যুৎ মিত্রকে। আমি বলব, সঠিক সময় সঠিক কোচ নির্বাচন। ভোরবেলা থেকে প্রদ্যুৎদা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহিলা টিমকে ট্রেনিং করাতেন। এবং সেই ট্রেনিংয়ের ফসল কারা জানেন? শ্রীরূপা বসু। লোপামুদ্রা ভট্টাচার্য। সন্ধ্যা মজুমদার। এবং শর্মিলা চক্রবর্তী। সন্ধ্যা মজুমদার দারুণ ব্যাট করতেন। শর্মিলা চক্রবর্তী ছিলেন দুর্ধর্ষ বাঁ-হাতি স্পিনার। আর শ্রীরূপা তো অধিনায়ক। সেই সময় দক্ষিণ ভারত থেকে উঠে আসে শান্তা রঙ্গস্বামী। মুম্বই থেকে ডায়না এডুলজি। শর্মিলা-শান্তা-ডায়না– অচিরেই এঁরা ভারতীয় ক্রিকেটের ত্রিমূর্তি হয়ে যায়!
(চলবে)
অনুলিখন: রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
