রাজু মুখোপাধ্যায়: গতকালের লেখাটা ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের সর্বপ্রথম ত্রয়ী শর্মিলা চক্রবর্তী-ডায়না এডুলজি-শান্তা রঙ্গস্বামীকে দিয়ে শেষ করেছিলাম। লিখেছিলাম, কীভাবে এঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশে মহিলা ক্রিকেটের প্রসার ধীরে ধীরে ঘটাচ্ছিলেন। পরবর্তী সময়ে খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরেও ক্রিকেটের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন গার্গী বন্দ্যোপাধ্যায়, মিঠু মুখোপাধ্যায়রা। ম্যাচ অফিসিয়ালের দায়িত্ব পালন থেকে জাতীয় নির্বাচকের গুরুভার নেওয়া, এঁরা সামলেছেন। কিন্তু দুঃখের হল, ভারতীয় বোর্ড সেই সময় মহিলা ক্রিকেট নিয়ে অদ্ভুত রকম উদাসীন ছিল। ভাবতে পারেন, সেই উদাসীনতার খেসারত দিতে হয়েছে বিশ্বকাপে। প্রথম মহিলা বিশ্বকাপে ভারত দলই পাঠাতে পারেনি! কাকে যোগাযোগ করতে হবে, কীভাবে কী করতে হবে, কেউ তো জানতেন না। বোর্ড থেকে ন্যূনতম সহায়তাটুকু পর্যন্ত সেই সময় পাওয়া যায়নি। তাই অ্যাপ্লিকেশন করা সম্ভব হয়নি।
অথচ পুরুষদের বিশ্বকাপের আগে শুরু হয়েছে মহিলা বিশ্বকাপ। ঠিকই পড়লেন। পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ভূমিষ্ঠ হয় ১৯৭৫ সালে। আর মহিলাদের সর্বপ্রথম বিশ্বকাপ হয় ১৯৭৩ সালে। পরিষ্কার বলছি, লম্বা সময় পর্যন্ত আমাদের দেশে ভুগেছে মহিলা ক্রিকেট। ২০০৫ সালে শরদ পাওয়ার বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুই হয়নি। মাথায় রাখবেন, পাওয়ারও একজন দুঁদে রাজনীতিবিদ ছিলেন। এবং অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর উনি বলেন যে, বিদেশ থেকে মহিলাদের টিম আমাদের দেশে খেলতে আসছে। আমাদের টিম খেলতে যাচ্ছে। তা হলে কেন মহিলা টিম বোর্ডের অধীনে আসবে না? যাঁরা খেলছেন, তাঁরা তো দেশেরই মেয়ে, ভারতেরই মেয়ে। লিখলাম না, রাজনীতিবিদরা ইচ্ছে করলে অনেক ভালো কিছু করতে পারেন। পাওয়ারকে দেখুন। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখুন। হকি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম গড়ে দিয়েছেন বাংলায়। শনিবার সিএবি-র অনুষ্ঠানে গিয়ে রিচাকে বঙ্গভূষণ পুরস্কার দিলেন। ব্যাট-বলের সোনার হার পরিয়ে দিলেন। রাজ্য পুলিশের ডিএসপি পদের নিয়োগপত্র দিলেন। একজন পারফর্মার তো এই স্বীকৃতি-সম্মানই চায়।
যাক গে। মহিলা ক্রিকেটের প্রেক্ষিতে আরও একজনের কথা না লিখলেই নয়। তিনি, পলি উমরিগড়। পাওয়ারের প্রস্তাব শোনামাত্র উমরিগড় সব রকম সহায়তা করতে নেমে পড়েন। বোর্ডের অধীনে এল দেশের মহিলা ক্রিকেট। আর্থিক দিকটাও কিছুটা উন্নত হল। বলছি না, রাতারাতি সব বদলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু হয়েছিল। যেমন ধরা যাক, যাতায়াত খরচ। আগে মহিলা টিম ট্রেনে আনরিজার্ভড কম্পার্টমেন্টে গেলে, পাওয়াররা আসার পর রিজার্ভেশনে যেত। দ্বিতীয় শ্রেণির কামরা থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হল। পরে ফ্লাইট হল। আরও দু’জনের নাম আমি এখানে করব। নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন এবং তৎকালীন বোর্ডের প্রশাসনিক ম্যানেজার রত্নাকর শেঠি। পাওয়ার-সহ এই দু’জনের অবদান সবচেয়ে বেশি। এবং অবশ্যই উমরিগড়।
ক্রীড়াজুটি: পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ও আরতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভাবলে খারাপই লাগে যে, আমাদের দেশে মহিলা ক্রিকেটের উত্তরণ ঘটতে ঘটতে ২০০৫ হয়ে গেল। অথচ কী পরিমাণ উৎসাহ-অধ্যবসায় ছিল মহিলা ক্রিকেটারদের! পূর্ব লেখায় প্রদ্যুৎ মিত্রের কথা লিখেছি। লিখেছি, কীভাবে প্রদ্যুৎদা প্রতিদিন ভোরে এসে ট্রেনিং করাতেন। সেই সময় আরও একজন কিন্তু ঠায় বসে থাকতেন। মহিলা ক্রিকেটারদের সুবিধে-অসুবিধে দেখতে। কালীঘাট মাঠে, ভোর থেকে। তিনি, আরতি বন্দ্যোপ্যাধায়। প্রখ্যাত ফুটবলার ও কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী! যাঁকে আমরা পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় নামে চিনি!
তাই বলছি, একদিনে কিছু হয়নি। একদিনে ঝুলন গোস্বামী-রিচা ঘোষরা তৈরি হয়নি। অনেকের আত্মত্যাগ, অনেকের পরিশ্রম, রিচাদের সফরে মিশে রয়েছে। যাঁদের এই সোনার মুহূর্তে ভুলে যাওয়াটা ঘোর অপরাধ। তাতে নিজেদের প্রতি নিজেরাই অবিচার করব আমরা। আজকাল কাগজ খুলে রোজ ফুটবল গড়াপেটার খবর দেখি। রোজ দেখছি, কেউ না কেউ ময়দানে ম্যাচ গড়াপেটা করছেন। যাঁরা করছেন এ সমস্ত, তাঁদের বলব খেলাটা নিয়ে একটু ভাবুন। খেলোয়াড়দের কথা একটু ভাবুন। আর কত আখের গোছাবেন নিজেদের? কত আর অন্যায়ের অর্থ পকেটে ভরবেন? প্লেয়ার তৈরি করলে তবে না কর্মকর্তাদের অস্তিত্ব। আর শিখতে চাইলে, রাজনীতিবিদদের দেখে শিখুন। যাঁদের লোকে নিত্য গালিগালাজ করে, তাঁরা কিন্তু আমাদের দেশের খেলাধুলোকে অনেক এগিয়ে দিয়েছেন। মহিলা ক্রিকেটকে তো অবশ্যই। (সমাপ্ত)
অনুলিখন: রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
