আধুনিক কাপুরুষতা তাঁকে ভাবায়। 'ডেসপ্যাচ' মুক্তির আগে মুম্বই থেকে সাক্ষাৎকারের সময় জানালেন পরিচালক কানু বহেল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
মুম্বইয়ের একজন ক্রাইম রিপোর্টারের জীবন নিয়ে ছবি ‘ডেসপ্যাচ’ (Despatch Movie), আজ থেকে (শুক্রবার) দেখা যাচ্ছে Zee5 প্ল্যাটফর্মে। ‘তিতলি’, ‘আগ্রা’র পর এমন একটা বিষয় নিয়ে ছবির ভাবনা কোথা থেকে এল?
‘আগ্রা’র পর নানা বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলাম। তারপর গৌরী লঙ্কেশের খুনের ঘটনা ঘটে। ওটা আমাদের কাছে একটা ট্রিগার পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল। রাইটিং রুমে বসে মনে হচ্ছিল একটা শিফট বা পরিবর্তন হচ্ছে এবং সেটা কী, কেন বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তখনই ক্রাইম জার্নালিজমের জগৎটা এক্সপ্লোর করার ভাবনা মাথায় এল। এবং রিসার্চের সময় বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা জিনিস সামনে এল। যত গভীরে গিয়ে ইনসাইডারদের সঙ্গে কথা এগোয়, সকলের মুখেই ঘুরে ফিরে একটাই বুলি– ‘কুছ ভি নহি পতা চল সকতা’। যে পৃথিবীতে আমরা আছি সেখানে এটা বলা প্রায় অসম্ভব কোন ঘটনার পিছনে আসলে কে আছে, কে কোন কলকাঠি নাড়ছে! বর্তমান সময়ে কোনও ক্রাইমের উৎস পর্যন্ত পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব কারণ কর্পোরেট নেক্সাস এবং আরও বিভিন্ন নেক্সাস জড়িয়ে থাকে। ক্রাইমের জগৎটা এখন খুব ধোঁয়াশাময়, অ্যাঙ্গুলার এবং ক্রাইম সাংবাদিকতার সঙ্গে সেই জগতের ইন্টারসেকশন সিনেমার পর্দায় বেশ একরৈখিক ভাবে দেখানো হয়।
সেই কারণেই কি আপনার ছবিতে মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত কেন্দ্রীয় চরিত্র এই সাংবাদিক হিরো নয়!
হ্যাঁ, মানে ‘ডেসপ্যাচ’-এ আমি ক্রাইম কে করেছে, কেন করেছে সেটা ফোকাসে রাখতে চাইনি। থ্রিলার বা আরেকটা স্ক্যামের গল্প বলতে চাইনি। সেটা খুব রেলিভ্যান্ট নয়। যে সময়ে আমরা বেঁচে আছি সেটাকে এক্সপ্লোর করতে চেয়েছি এমন এক চরিত্রের মাধ্যমে, যে আমাদের রিপ্রেজেন্ট করে। এবং যে আমাদের হিরোইক ভার্সান নয় বরং ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, আমরা হিরো নই, আমরা মানুষ। ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে আধুনিক অপরাধ জগতের ইন্টারসেকশন, কী ভাবে কাজকর্ম চলে, সেই ল্যান্ডস্কেপ কেমন, এটা তুলে ধরাই মুখ্য ছিল। সাধারণত আমরা সিস্টেমকে দোষ দিই। কিন্তু সিস্টেম তো আমরাই। এবং আমাদের ছবির সাংবাদিকও সিস্টেমের অংশ। তাই ‘জয়’-এর মতো ‘ফস্টিয়ান’ চরিত্রকে ক্রিয়েট করা, যার নিজস্ব লক্ষ্য আছে, লোভ আছে, দুর্বলতা আছে এবং যেটা এই ধোঁয়াশাময় জগতের দিকে তাকে ঠেলে দেয়। এই দুর্বলতা বা শিরদাঁড়াহীনতা তার জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে, সেটা দেখার। আপনি কি সেই রাস্তায় হাঁটতে চান! আমার কাছে ‘আধুনিক কাপুরুষতা’, বা এই ল্যাক অফ স্পাইন যেভাবে কাজ করে সেটা খুব ইন্টারেস্টিং।
পরিসংখ্যান বলে গত দশ-পনেরো বছরে গৌরী লঙ্কেশ-সহ ২৮ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ছবিতে সংলাপ আছে ‘আমি বেঁচে আছি কারণ চুপ করে আছি’। আমাদের দেশে এটাই পরিণাম!
এটা এখন গোটা পৃথিবী জুড়ে চলছে। রাশিয়ার কথা ভাবুন। সেখানে এমনকী, জানালা দিয়ে পড়ে মানুষের মৃত্যু রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা সত্যের গভীরে পৌঁছতে চাইছে তাদের মৃত্যুর জন্য কেবল এক্সটারনাল ফ্যাক্টর দায়ী, এটা খুব সরল ন্যারেটিভ বলে আমার মনে হয়। একহাতে তালি বাজে না। এটা যতটা এক্সটারনাল কারণে ঘটে ততটাই ইন্টারনাল কারণে। ‘ডেসপ্যাচ’-এর মধ্যে দিয়ে যেটা এক্সপ্লোর করতে চেয়েছি– এই সিস্টেম কারা তৈরি করে, সিস্টেম বদলাতে চাইলে আমাদের দায়িত্ব কী? আমরা কী অ্যাকশন নিচ্ছি যার ফলে এই সিস্টেম সাসটেন করছে।
এই পৃথিবীতে স্বস্তি খুঁজতে হলে কী করবেন? এই কর্পোরেট নেক্সাস, সারভিলিয়েন্স, পোলারাইজড সমাজে আপনার সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি কী? ছবি বানানো?
ইট’স বিকামিং এ ডগ ইট ডগ ওয়ার্ল্ড। আমার মনে হয় না, গা বাঁচিয়ে থাকা সম্ভব। আর শান্তি খোঁজাও যাবে বলে মনে হয় না, কারণ চোখের সামনে একের পর এক ঘটে চলেছে।
শিল্পী হিসাবে, ব্যক্তি হিসাবে এই সব ঘটনায় কীভাবে ট্রিগার্ড হন?
সম্প্রতি কলকাতায় আর.জি.কর-এ তরুণী হত্যার পর প্রতিবাদ, মিছিল– সবকিছুর পর যেই কে সেই। নানা ন্যারেটিভের খেলার পর নীরবতা! এটা নিয়ে আমার মিক্সড ফিলিংস কাজ করে। একজন ফিল্মমেকার হিসাবে বা ব্যক্তি মানুষ হিসাবে এই ধরনের ঘটনায় ট্রিগার্ড হওয়া আমরা অ্যাফর্ড করতে পারি না। কারণ ট্রিগার্ডের রিঅ্যাকশন সব সময় সেন্টিমেন্টাল হয়। পৃথিবীজুড়ে যা ঘটছে তা অনুধাবন করে একটা সমঝোতায় আসতে গেলে এমপ্যাথেটিক হওয়া বেশি জরুরি, সিমপ্যাথেটিক হওয়ার চাইতে। একজন সংবেদনশীল ব্যক্তি হিসাবে এই সময় এবং সমাজকে যখন প্রতিফলিত করার চেষ্টা করব, তখন সব কিছু ভিতরে নিয়ে অবজেক্টিভলি দেখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ শুধু ট্রিগার্ড এবং সেন্টিমেন্টাল হয়ে রিঅ্যাক্ট করলে, কাজের কাজ কিছু হয় না। সূক্ষ্মভাবে খতিয়ে, গ্লোবাল পারস্পেক্টিভ মাথায় রেখে লড়াই করতে হবে। রিয়্যালিটিকে সব দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, কেবল রেগে গিয়ে কোনও একজনকে ভিলেন বানানো সোজা। কিন্তু যে বা যারা এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, তারাও এই সমাজেরই অংশ। তাদের বিকৃতির উৎস না বুঝতে পারলে সিস্টেম বদলানো যাবে না।
ছবিতে ‘জয়’-এর, তার চারপাশের নারীদের সঙ্গে সম্পর্কে খুব সহজ নয়। তার স্ত্রী, প্রেমিকা এমনকী, নিজের মায়ের সঙ্গেও। শেষ বিদায়ের আগে মাকে না জড়িয়ে ভাইকে জড়ায়। বেশিরভাগ পুরুষ কি এমনই বলে মনে হয়?
এটা খুব ট্রিকি সাবজেক্ট। পিতৃতন্ত্র আসলে পুরুষদের বেশ কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। পিতৃতন্ত্র বলে পুরুষকে কন্ট্রোলে থাকতে হবে। তুমিই হবে সংসারের ধারক ও বাহক। তুমি নিজেকে নির্দিষ্টভাবে চালনা করবে। এবং এটা পুরুষদের মধ্যে একটা রিপ্রেশন তৈরি করে। তাদের অন্যান্য অনুভূতিগুলোকে সামনে আসতে দেয় না। পিতৃতন্ত্র যেমন মহিলাদের দমন করে তেমন পুরুষদেরও নানাভাবে পঙ্গু করে দেয় যখন ইমোশনের বিষয় আসে। কারণ রোল প্লে-তে তাদের শক্তিশালী হতে শেখানো হয়।
মিলন দৃশ্যে সৌন্দর্যায়নের কথা ভাবা হয়নি তাই খুব স্বাভাবিক লাগে। এমন দৃশ্য শুট করতে অসুবিধে হয়নি?
না, খুব অসুবিধে হয়নি শুটিংয়ের সময়। প্রিপারেশনের সময়টা একটু কঠিন ছিল। যখন অভিনেতারা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করে। প্রত্যেকে একে অপরের কাছে স্ট্রেঞ্জার। পরিচালক হিসাবে অভিনেতাদের সঙ্গে অনেস্ট কনভারসেশন তৈরি করতে হয়েছে। কনফিডেন্স এবং ট্রাস্ট গড়ে তুলতে হয়েছে। এবং তাদের বিশ্বাস করাতে হয়েছে ছবিতে লাভমেকিং দৃশ্য সেনসেশন তৈরি বা সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য রাখা হয়নি। আসলে এগুলো কেবল সেক্স সিন নয়, সেই সব দৃশ্যে আসলে দুজন চরিত্রের মধ্যে ইমোশনাল ট্রানজাকশন হচ্ছে। আমরা শুধু একটা ইনটিমেট স্পেসের প্রেক্ষাপটে চরিত্রদের আসল সত্তা বের করে আনতে চেয়েছি। তাই দর্শকের দেখার চোখও অন্যভাবে কাজ করবে, কারণ যৌনদৃশ্য সেনসেশন ক্রিয়েট করার মতো করে লেখা হয়নি বা শুট করা হয়নি। তাই শুটের দিনটা ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জিং হলেও, ইট ওয়াজ মেকানিক্যাল।
নতুন ছবির কথা ভাবছেন? আপনার ছবি ‘আগ্রা’ কবে মুক্তি পাবে?
আমি কয়েকটা ভাবনা নিয়ে কাজ করছি, দেখা যাক। আমরা চেষ্টা করছি ‘আগ্রা’ যাতে কোনওভাবে মুক্তি পেতে পারে। দেখা যাক কী হয়।