shono
Advertisement

কহেন কথা আকাশপ্রদীপ

সারা কার্তিক মাস কেন আকাশে আলো দেওয়া হয়? আকাশপ্রদীপ সেই কথা গল্পচ্ছলে জানাল অনির্বাণ চৌধুরীকে। The post কহেন কথা আকাশপ্রদীপ appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 09:24 PM Oct 17, 2016Updated: 07:26 PM Oct 17, 2016

আশ্বিনের শেষ দিন থেকে কার্তিক মাসের শেষ দিন পর্যন্ত একমাস কেন আকাশে আলো দেওয়া হয়?  আকাশপ্রদীপ সেই কথা গল্পচ্ছলে জানাল অনির্বাণ চৌধুরীকে

Advertisement

ঋতু হেমন্ত, মাস আশ্বিন, সংক্রান্তি। হাওয়ার বদল আমি টের পাচ্ছি। সে এসে গিয়েছে। কুয়াশায় আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরে। একটা আলো দেখালে হয়তো তার সুবিধে হবে আসতে। যদিও সে এসে গিয়েছে বলে উত্তর দিক থেকে একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
ওই হাওয়ায় আকাশপ্রদীপগুলোর অসুবিধে হচ্ছে খুবই! কিন্তু তারা সেটা গায়ে মাখছে না। বাঁশের ডগায় নিশ্চিন্তে বসে, কাচ বা কাপড়ের ঘেরাটোপে গল্প বলছে একেকটা। জন্মান্তরের গল্প। সেই সময় থেকে যখন ঋতু নাম পায়নি। অন্ধকারও তখন এই সময়ের মতো আলোকিত নয়।
খুব সাবধানে গুহার মুখের পাথরটা সরিয়ে সেই অন্ধকারে নেমে আসে এক যুবক। অভিমানের মতো জমাট অন্ধকার। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায় সে। তারাগুলো তার চোখ ঝলসে দেয়। হাওয়ার হিম কাঁটার মতো বেঁধে গায়ে। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় পিছন ফিরে গুহার ভিতরটা একবার দেখে নেয় সেই আদিম মানুষ। গুহায় এখনও আগুন জ্বলছে। শীত আসছে। একে নিভতে দেওয়া যাবে না।
আকাশের আলো নিভে গিয়েছে। নদীর ধার দিয়ে নগরের দিকে হেঁটে চলেছেন হুক্ক। মৃত্যুর পরেও তিনি বিজয়নগরের মায়া কাটাতে পারেননি। তুঙ্গভদ্রা ঘিরে এক সময়ে প্রতিষ্ঠা করা তাঁর নগরের কাছেই থাকেন। হেমন্তের এই কার্তিকী অমাবস্যার অন্ধকার তাঁর গতি অবশ্য কিছু রোধ করেছে। হুক্ক অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজয়নগরের পাহাড়ের মাথায় বিশাল আগুন জ্বলবে। আকাশে ভেসে থাকা এক প্রদীপের মতো। সেই আলো নেমে আসবে এই পথেও। অপেক্ষা করতে করতে ঈষৎ অধৈর্য হয়ে পড়লেন তিনি। শত্রু আসার খবরটা নগরে তাড়াতাড়ি দিতে পারলেই ভাল হয়।


অন্য দিনের মতো আজও খুব সকালে ভেঙে গেল গোরার। সবে হেমন্ত, কিন্তু ভাগীরথী ছুঁয়ে আসা হাওয়া শীতের মতোই শীতল। আলস্য কাটিয়ে সে এসে দাঁড়াল ঘরের বাইরে। আশ্বিনের শেষ দিনে জলবিষুব সংক্রান্তি পালনের উদ্যোগ চলছে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ পরিবারে। এই জলবিষুব সংক্রান্তি থেকে ষড়শীতি সংক্রান্তি বা কার্তিক মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে ব্রত-উৎসব। বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ্যজীবনের যা এক অবশ্য কর্তব্যও বটে। বিশেষ করে যবনী শাসনের এই কালে নিজেদের আচার-ধর্ম রক্ষায় একটু বেশিই উদ্যোগী হয়ে উঠেছে ব্রাহ্মণরা।
সৌর কার্তিক মাসের এই ব্রত পালনের তাৎপর্য যে গোরা জানে না- তা নয়। ছোট থেকেই দেখে আসছে। বয়স আরও একটু কম থাকতে নিজের হাতে বানিয়েছেও মাটির প্রদীপ। পিতার কাছে শুনেছে, এই প্রদীপ আসলে দেহেরই প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে যেমন তৈরি হয় এই নশ্বর শরীর, মাটির প্রদীপটিও তাই! ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ বা জলে তা আকার পায়। তেজ বা আগুন আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করে। আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে।
পিতা আরও বলতেন, কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া শুধুই বিষ্ণুর আশীর্বাদ যাচনা নয়। তাঁকে তো স্মরণ করতেই হবে। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ‘’আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।‘’ আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু, তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ। এ বাদেও আকাশপ্রদীপ শীতঋতুতে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যাস। যা অনেক পরে রূপান্তরিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে।


তার জন্য  যজ্ঞের উপযোগী এক বৃহৎ কাঠের এক পুরুষপ্রমাণ দণ্ড নির্মাণ করা হয়। তাতে যবাঙ্গুল পরিমাণ ছিদ্র করে লাগানো হয় দু’হাত পরিমাণ রক্তবর্ণের পট্টি। সেই অষ্টকোণযুক্ত পট্টির ভিতরে রাখা হয় এই দেহের প্রতীক প্রদীপটি। স্থাপনের সময় বলা হয়- ‘’দামোদরায় নভসি তুলায়াং লোলয় সহ/প্রদীপং তে প্রযচ্ছামি নমোহনস্তায় বেধসে।‘’ কাৰ্ত্তিকমাসে লক্ষ্মীর সঙ্গে দামোদরকে আমি আকাশে এই প্রদীপ দিচ্ছি। বেধ অনন্তকে নমস্কার।
গোরা দেখেছে, অনেক ব্রাহ্মণ পরিবার আকাশপ্রদীপ স্থাপনের সময় উচ্চারণ করেন- ‘’নিবেদ্য ধৰ্ম্মার হরায় ভূম্যৈ দামোদরায়াপ্যথ ধৰ্ম্মরাজে/প্রজাপতিভ্যত্বথ সৎপিতৃভ্যঃ প্রেতেভ্য এবাথ তমঃ স্থিতেভ্যঃ।‘’ তাঁরা শুধুই আকাশপ্রদীপটি লক্ষ্মী-নারায়ণকে নিবেদন করেন না। তার সঙ্গে আবাহন করেন পিতৃলোকে, প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদেরও। যাতে তাঁরা সেই আলোয় পথ চিনে আশীর্বাদ দিতে আসতে পারেন উত্তরসূরীদের। যবন শাসনের সময় এভাবেই আরও দৃঢ় করে নেন তাঁরা স্বধর্মের, স্ববংশের ভিতটুকু। সবই বোঝে গোরা, কিন্তু কোথাও তার মনে একটু সন্দেহও দেখা দেয়। যদি যবন শাসনের হাত থেকে সংস্কৃতিকে উদ্ধার করতেই হয়, তবে আরও বৃহৎ কোনও ধর্মাচার প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ্যবাদ তো অন্ত্যজদের গ্রহণ করে না। কিন্তু, তাদেরও কি পূর্বপুরুষ নেই? না কি তারা হিন্দু নয়। সে ভাবতে থাকে।
একটানা এতটা জানিয়ে চুপ করে যায় আকাশপ্রদীপ। হিমের সঙ্গে নিস্তব্ধতা নেমে আসতে থাকে শহরের রাতে। আমিও তাকিয়ে দেখি, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শহরের ব্যস্ততায় কোথাও একটা সে গা ঢাকা দিয়েছে। অভিমানে?


হতেই পারে। আজকাল কেউ তার কথা বড় একটা ভাবে না। ভুলে গিয়েছে তাকে। আজ জলবিষুব বা আশ্বিন সংক্রান্তি থেকেই তার আকাশ আলো করার কথা। কিন্তু, তিল তেল বা ঘিয়ের প্রদীপ কে সময় খরচ করে দেবে? তাই কর্তব্য সারা হবে বিদ্যুতের আলোতেই। বাঁশের ডগায় লাল টুনি জ্বলবে। সেই আলোতেই পথ চিনে, শীতের হাত ধরে একে একে গৃহে উপস্থিত হবেন পূর্বপুরুষরা। সেই আলোর নিশানা ধরে রাতের আঁধার পাড়ি দেবে পরিযায়ীরাও। বিষ্ণুর সৃষ্টি করা পৃথিবীর জীবনের চাকাটি ঘুরতে থাকবে নিজের নিয়মে।
সেই আলোও অবশ্য কমে এসেছে ক্ষীণ হতে হতে। হেমন্ত জুড়ে থাকা কার্তিকে আকাশপ্রদীপের বৈদ্যুতিন আলোও এখন আর বড় একটা চোখে পড়ে না। গত বছরে নজরে পড়েনি তেমন করে। এ বছরে কি পড়বে? সেই আলো পথ না দেখালে শীত এসে শহরে বসতে পারবে তো?
জিজ্ঞেস করলাম সেই কথা। আকাশপ্রদীপ কোনও উত্তর দিল না।

The post কহেন কথা আকাশপ্রদীপ appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement