shono
Advertisement

তুঙ্গে উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার জল্পনা, নেপথ্যে কোন সমীকরণ?

রাতারাতি কাশ্মীরকে দু’-টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়েছেন মোদি-শাহরা।
Posted: 01:53 PM Nov 08, 2022Updated: 01:53 PM Nov 08, 2022

ভোটের আগে উত্তরবঙ্গকে ভাঙার জল্পনা উসকে দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। দু’-একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, সবকিছুর পিছনে লোকসভা ভোটে বিজেপির আসনগুলি সুনিশ্চিত করার একটি গল্প রয়েছে। তবে সংবাদমাধ‌্যমের একাংশে বেনজির জল্পনা তৈরির পরেও রাজ‌্যভাগ নিয়ে বিভ্রান্তিটা ব‌্যাপকভাবে ছড়ায়নি। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

 

যে কোনও ভোটের আগেই উত্তরবঙ্গকে ভাঙার জল্পনা উসকে দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি দীর্ঘদিনের রেওয়াজ। উত্তরবঙ্গের মানুষও তা দেখতে অভ‌্যস্ত। বস্তুত, যখনই কোনও কোনও মহল থেকে উত্তরবঙ্গকে নিয়ে আলাদা রাজ‌্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার আওয়াজ তোলা হয়, তখনই সেখানকার মানুষ টের পায় ভোট আসছে। আবার এটাও বাস্তব যে, উত্তরবঙ্গকে ভাঙার এই জল্পনা থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভোটে ফায়দা পেয়েছে। উত্তরবঙ্গ আলাদা করার দাবি দুই বঙ্গে দু’রকম প্রভাব তৈরি করে। এই দুইয়ের মধ্যে একটি ভারসাম‌্যর রসায়ন তৈরি করে সেই রাজনৈতিক ফায়দা তোলা হয়েছে।

২০২৪-এর লোকসভা ভোট মাথায় রাখলে এবার অনেকটা আগেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা করার জল্পনা উসকে দেওয়া হয়েছে। যদি পঞ্চায়েত ভোটকে ‘লক্ষ‌্য’ করা হয়, তাহলে অবশ‌্য ভিন্ন প্রশ্ন। পঞ্চায়েত ভোট আর তিন-চার মাস দূরে। তার আগে উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার জল্পনা উসকে কেউ কেউ হাওয়া গরম করতেই পারে। কিন্তু এবার যে-কায়দায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ধারণাটি সামনে এসেছে, তাতে স্পষ্ট যে, বিষয়টি শুধু পঞ্চায়েত ভোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ভাবনা-চিন্তা আরও দীর্ঘ। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিহারের লাগোয়া তিন-চারটি ও নিম্ন-অসমের একটি জেলার অংশবিশেষ। অর্থাৎ লোকসভা ভোটের সমীকরণকেই মাথায় রাখা হচ্ছে।

[আরও পড়ুন: থমকে ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্যে, সুনাক কি সেই জট খুলতে পারবেন?]

দু’-একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, সবকিছুর পিছনে লোকসভা ভোটে বিজেপির আসনগুলি সুনিশ্চিত করার একটি গল্প রয়েছে। উত্তরবঙ্গে গত লোকসভা ভোটে আটটি কেন্দ্রেই বিজেপি জয় পেয়েছিল। দু’বছর বাদে বিধানসভা ভোটে ছবিটা অনেকটাই বদলে যায়। তারপরে রাজ‌্য-রাজনীতিতে আরও ওঠাপড়া ঘটেছে। এই সময় উত্তরবঙ্গে বিজেপির যেটুকু সাংগঠনিক শক্তি গড়ে উঠেছিল, তার প্রভূত ক্ষয় হয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে সাম্প্রতিক পুর নির্বাচনে। দক্ষিণবঙ্গের মতোই শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের সর্বত্র পুরভোটে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে বিজেপি। বিধানসভা ভোটের পরেই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লা মালদহ থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের ধারণাটি বাজারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যদিও সরকারিভাবে তৎক্ষণাৎই বিজেপির তরফে এই ধারণার বিরোধিতা করা হয়। কিন্তু, তিস্তা-মহানন্দা দিয়ে আরও কিছু জল প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংশয় দানা বাঁধে যে, বার্লার ওই ঘোষণার পিছনে বিজেপির কোনও কৌশলী চাল থাকলেও থাকতে পারে। সম্প্রতি, ফেরার কেএলও জঙ্গি জীবন সিং ও ‘গ্রেটার কোচবিহার’ আন্দোলনের নেতা অনন্ত মহারাজকে সামনে রেখে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জল্পনাকে ব‌্যাপকভাবে পল্লবিত করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে জোড়া হয়েছে বিহারের কিষানগঞ্জ, পূর্ণিয়া, কাটিহার ও আড়ারিয়া জেলা এবং অসমের ধুবড়িকে। মোট ৮০টি বিধানসভা কেন্দ্রকে নিয়ে এক বিরাট অঞ্চল।

বিজেপির কোনও কোনও মহল থেকে এই তত্ত্ব ছড়ানো হচ্ছে যে- উত্তরবঙ্গ, বিহার ও অসমের এই অংশগুলি নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা গেলে লোকসভায় অন্তত ১২টি আসনে জয় সুনিশ্চিত করা সম্ভব। গতবার বিহার, বাংলা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা মিলিয়ে বিজেপি ৫৪টি আসনে জয় পেয়েছিল। এবার এই অঞ্চলের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ৫৪টি আসন ধরে রাখা সম্ভব নয়, তা বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন। নীতীশ কুমার হাত ছেড়ে দেওয়ার পর বিজেপির পক্ষে বিহারে গতবারের ১৭টি আসন ধরে রাখা একপ্রকার অসম্ভব। নীতীশ, লালু ও কংগ্রেসের মহাজোট ঠিকঠাক কাজ করলে বিহারে বিজেপি শূন‌্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে গতবার লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন জিতেছিল বিজেপি। বিধানসভা ও পুরসভার নির্বাচনে তাদের ভোটের নিম্নগতি ধরলে বিজেপির ভোট লোকসভা নির্বাচনে তলানিতেও চলে যেতে পারে। ঝাড়খণ্ডেও বিজেপির পরিণতি কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। এ জায়গায় দাঁড়িয়ে বিজেপিকে কৌশল নিতে হতে পারে এই চার রাজ্যে ন্যূনতম কিছু আসনে যে কোনওভাবে জয় সুনিশ্চিত করার। বিজেপির এই মহলটির দাবি, অসমকে বাদ দিলেও বাংলা-বিহারের অংশ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলে অন্তত সেই এলাকায় প্রশাসনকে পূর্ণমাত্রায় ব‌্যবহার করে ১০-১২টি আসন জেতা সম্ভব হতে পারে।

বিজেপির এই মহলের বক্তব‌্যর পক্ষে দলের নেতাদের সম্মতি রয়েছে বলে এখনও শোনা যায়নি। বিভিন্ন সংবাদমাধ‌্যমে এ বিষয়ে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তার সপক্ষে বিজেপি নেতৃত্বর কোনও বক্তব‌্য পাওয়া যায়নি। বিজেপির রাজ‌্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, ‘বঙ্গভঙ্গ নিয়ে সংবাদমাধ‌্যমে যেসব জল্পনা চলছে তার কোনও ভিত্তি নেই। শ‌্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ‌্যায়ের নীতি মেনে অখণ্ড পশ্চিমবঙ্গের পক্ষেই বিজেপি।’ কিন্তু, একইসঙ্গে অনন্ত মহারাজের সঙ্গে বৈঠক করে রাজ‌্যভাগের জল্পনাকেও ইন্ধন দিচ্ছেন কোনও কোনও বিজেপি নেতা। অনন্ত মহারাজ বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন যে, রাজ‌্যভাগ সময়ের অপেক্ষা। অসমের মুখ‌্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে জীবন সিংয়ের যোগাযোগের খবর প্রকাশ্যে আসছে।

রাজ‌্যভাগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ইসু‌্যকে সামনে রেখে বিজেপির নেতা ও মন্ত্রীরা কি এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারেন? কোন কারণে এবং কীসের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করা হবে, তার কোনও বোধগম‌্য যুক্তি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা-ভাগের তীব্র বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের একটি অংশে সামান‌্য কিছু মানুষ আলাদা কিছু দাবি করলেই কি এইভাবে রাজ‌্য ভেঙে দেওয়া যায়? তেলের শিশি ভাঙার মতোই কি সহজ রাজ‌্যকে ভেঙে দেওয়া? শিলিগুড়ির কাছে ‘চিকেন নেক’-এর মতো সরু করিডরটির নিরাপত্তা নিয়ে কেন্দ্র উদ্বিগ্ন বলে মাঝে মাঝেই একটা বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই ‘চিকেন নেক’-এর নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাংলা ও বিহারের একাংশ ভাঙা হবে বলে স্বার্থান্বেষী মহল থেকে প্রচার চলছে।

রাতারাতি কাশ্মীরকে দু’-টুকরো করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। রাজ্যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে যে, একই পথে রাতের অন্ধকারে সংসদে বিল এনে উত্তরবঙ্গ ও বিহারের একাংশ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা হয়ে যাবে। সম্প্রতি, একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ‌্যমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে- বাংলা, বিহার ও অসম ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার কোনও পরিকল্পনা মন্ত্রকের তরফে গ্রহণ করা হয়নি। এ ব‌্যাপারে কোনও আলোচনাও কখনও হয়নি। বিভিন্ন মহলের মাধ‌্যমে গুজব ছড়িয়ে এবং নেতৃত্বের তরফে নানারকম রহস‌্যজনক বৈঠক করে ও ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণের মাধ‌্যমে বিজেপি কেন ফের আগুন নিয়ে খেলতে নামছে, তা উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে নিশ্চিতভাবেই স্পষ্ট। তাই সংবাদমাধ‌্যমের একাংশে বেনজির জল্পনা তৈরির পরেও রাজ‌্যভাগ নিয়ে বিভ্রান্তিটা ব‌্যাপকভাবে ছড়ায়নি। মানুষ সম্ভবত বোঝে আলাদা রাজ‌্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটা হাতের মোয়া নয়। এই ধরনের জল্পনায় ইন্ধন দেওয়ার খেসারত যদি বিজেপিকে দিতে হয়, তাহলে তো লোকসভা ভোটে বিজেপির আরও সর্বনাশ!

[আরও পড়ুন: হরফ দেখে রহস্যভেদ! শার্লক-ব্যোমকেশের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এক মার্কিন গোয়েন্দা]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement