বাঘিনি ‘জিনাত’ এবং তার সন্ধানরত বাঘটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে চর্চা মনে করিয়ে দিল জীবজন্তুদের সাহিত্যিক অস্তিত্ব।
১৪ জানুয়ারি প্রায় সব বাংলা সংবাদপত্র একটি বাঘের জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার চমৎকার ছবি ছেপেছে। সুন্দরবনের ধূলিভাসিনি জঙ্গলের ধারে নদী। নদী সাঁতরে লোকালয় থেকে সুন্দরবনে ফিরে যেতে এই ঝাঁপ। কদিন ধরেই এক বাঘ আর বাঘিনির গল্প সংবাদপত্রে বেরচ্ছে। বাঘিনির নাম ‘জিনাত’। বছর দশেকের তরতাজা বাঘ এখনও কোনও মানব-নাম পায়নি, সে শুধুই বাঘ। তবে সংবাদপত্রে বাঘ-বাঘিনির গল্পে এসেছে রূপকথার ছোঁয়া। বাঘটা নাকি খুঁজে বেড়াচ্ছে বাঘিনি জিনাতকে। তবে তার এই সন্ধান এক ধরনের ভ্রান্তিবিলাস। যে-পথে জিনাত হাঁটছে জঙ্গলে, বাঘ তাকে খুঁজছে উলটোপথে! তার এই ভ্রান্তিতে যুক্ত হয়েছে আরও এক রহস্য। বনকর্মীরা বাঘটাকে যেইমাত্র নদীতে মুক্তি দিয়েছে জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার জন্য, অমনি নাকি সুন্দরবনের লোকালয়ের কাছেই দেখে গিয়েছে বাঘের পায়ের ছাপ! এ আবার কোন বাঘের আকস্মিক আবির্ভাব!
মনে পড়তে পারে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বাঘ নিয়ে রোমান্টিক পদ্যের পঙ্ক্তিসারি: “মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে/ চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ বেরুলো বনে–/ আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললাম ‘খা’/ আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।” শক্তিই সেই বাঙালি, যিনি অনুভব করেছিলেন বাঘের শরীর, মন,
মান-অভিমান, রূপের বাহার। জন্তু-জানোয়ার নিয়ে রূপকথার, বিচিত্র কাল্পনিক গল্পের শেষ নেই মানব ভাবনার।
মানুষ নিজের নানা দোষ-গুণ খুঁজে পেয়েছে নানা প্রাণীর মধ্যে। মহাভারতের বক ধর্মের প্রতীক। কিন্তু আধুনিক কালের বাঙালির কাছে বকধর্ম তো ধর্মের মুখোশ পরা শয়তানি। ‘বকধার্মিক’ বলতে আমরা এককথায় বুঝি এমন মানুষ যে আসলে ভণ্ড, ধার্মিকের ভেক ধরে চতুর অপকর্ম করে বেড়ায়। শিয়াল আর বাঘের গল্প নানা উপাখ্যানে পাওয়া যায়। ঈশপের গল্পে শিয়াল কখনও চতুর, কখনও শয়তান। আর বাঘ তার বেদম শারীরিক শক্তি সত্ত্বেও বোকা। মানুষ আবার হাতিকে কখনও বানিয়েছে বন্ধু– যেমন টারজনের গল্পে।
অথচ হাতির পাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেভাবে মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙে, শস্য নষ্ট করে, অন্য কোনও প্রাণী করে কি? এদিকে তার স্মৃতিশক্তির স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক। আগাথা ক্রিস্টির একটি ডিটেক্টিভ উপন্যাসের নামই তো ‘এলিফ্যানন্ট রিমেমবার্স’। চিনা খাবারের দৌলতে যতই বাঙালি পর্ক-হ্যাম ভালবাসতে শিখুক, শুয়োর চিরদিন বাঙালির ধ্রুপদী মুখখারাপের সঙ্গে মিশে থাকবে বলেই মনে হয়। যদিও অরওয়েল সাহেব তাঁর আইকনিক উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ শুয়োরের নাম রেখেছেন ‘নেপোলিয়ন’, তাকে বসিয়েছেন ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে, তাকেই করেছেন মানব-শাসন থেকে জন্তুদের মুক্তি আন্দোলনের স্তালিনপন্থী নেতা এবং জন্তুদের সর্বনাশের প্রধান কারণ। বেছে-বেছে একটি শুয়োরকে এই স্থানে বসানো, এমন শূকরদর্শন কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল না ১৯৪০-এর দশকে! সে-দশক থেকে এ-দশক মূর্ত পশুপাখিরা বারেবারে হয়ে উঠেছে বিমূর্ত ভাবনার রূপকল্প। অথচ, বাস্তবে আমরা তাদের ততটাও সমাদর দিতে পেরেছি কি?