ডা. দত্তা সামন্তর কাছে চিকিৎসার পাশাপাশি নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে আসত শ্রমিকেরা। অচিরেই তাদের দাবি-দাওয়ার জন্য লড়াইয়ে নামেন সামন্ত। কাপড় কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে ৬৫টি টেক্সটাইল কারখানার প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিককে নিয়ে ১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি সামন্তর নেতৃত্বে ডাকা হয় ধর্মঘট– যা চলে দীর্ঘ ২০ মাস। আজ ধর্মঘটের ৪৩ বছর পূর্তি। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
তখন মহারাষ্ট্রে চলছে শিবসেনা-বিজেপির শাসন। দিনটা ছিল ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি। সকাল ১১টা ১০ নাগাদ মুম্বইয়ের পাওয়াই অঞ্চলের নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ‘ডাক্তার সাহাব’ (ওই নামেই পরিচিত ছিলেন শ্রমিক-নেতা দত্তা সামন্ত) টাটা সুমো করে ৫০ ফুট যেতে-না-যেতেই, গাড়ির সামনে মোটরসাইকেল করে চারজন এসে পড়ে। তাদের দেখে কোনও শ্রমিক ভেবে গাড়ির গতি কমাতে বলে জানালার কাচ নামান দত্তা সাহাব। তখনই ওই মোটর সাইকেলে আরোহীরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। দু’টি পিস্তল থেকে আততায়ীদের করা ১৭টি গুলি ঝাঁজরা করে দেয় দত্তা সামন্তর মাথা-বুক-পেট। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও, সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর খবর জানাজানি হতেই শহরে নানা প্রান্তে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়।
শেষযাত্রায় শামিল হয় বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের বহু মানুষ। আর ওই মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে– ‘যোশী মুন্ডে আজ কে গুন্ডে’। তখন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী মনোহর যোশী এবং উপমুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ মুন্ডে। আর, নেপথ্য থেকে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বালা সাহেব ঠাকরে। যদিও এক সময় এই দত্তা সামন্তর সঙ্গে সুসম্পর্কই ছিল বালা সাহেবের।
তবে এই ধরনের হত্যা নিয়ে চিরকালই রহস্য থেকে যায়। সাধারণত দেখা যায় অভিযুক্তরা পলাতক, সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেয় না কিংবা দিলেও পরে বয়ান বদলায়। যথারীতি তেমন কোনও নিষ্পত্তি ছাড়াই সামন্তর হত্যাকাণ্ডের ফাইল বন্ধ করে দেওয়াটা একদিক দিয়ে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর, তেমনটাই হয়েওছিল। ১৯৯৭ সালের নভেম্বরেই ওই হত্যা-মামলা কেস বন্ধ করা হয়, কোনও নিষ্পত্তি ছাড়াই। ১৬ জন অভিযুক্তের তালিকা তৈরি হলেও তাদের মধ্যে থেকে ন’জন এখনও ফেরার। এদের মধ্যে ছিল অন্ধকার জগতের ছোটা রাজন এবং গুরু সতম। তবে কয়েক বছর পর শ্রমিক নেতা দত্তা সামন্তর হত্যার অভিযোগে ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের একজনের নাম বিজয় চৌধুরী।
ঘটনাটা অদ্ভুত! সেই সময় উত্তরাঞ্চলের (অধুনা উত্তরাখণ্ড) দেরাদুন থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয় অপহরণের কেসে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে তারা সকলেই মুম্বইয়ে একটি হত্যাকাণ্ডে ‘ওয়ান্টেড’ তালিকাভুক্ত। সামন্তকে যে-চারজন সুপারি কিলার হত্যা করে এরা তাদেরই তিনজন। এরপর বিজয় চৌধুরী এবং তার অনুচরদের উত্তরাঞ্চল পুলিশ মুম্বইতে নিয়ে আসে। তখন দত্তা সামন্তর ভাই ফের তঁার দাদার হত্যাকাণ্ডের ফাইল খুলতে বলেন। এদিকে, আবার ২০০৭ সালে ৩০ অক্টোবর সামন্তর আর এক হত্যাকারী– যে অন্ধকার জগতের ছোটা রাজনের হয়ে কাজ করত বলে অভিযোগ– কোলাপুরে পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়। ওই হত্যার ২৬ বছর পর ২০২৩ সালে হত্যা ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত গ্যাংস্টার ছোট রাজনকে প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস করে দেয় সিবিআই বিশেষ আদালত।
ডাক্তারি পাস করে প্র্যাকটিস শুরু করলে দত্তা সামন্তর কাছে চিকিৎসা করাতে আসত কারখানার শ্রমিকরা। চিকিৎসা করার পাশাপাশি শ্রমিকদের দুর্দশার কথা শুনতেন। ফলে ডাক্তার সাহাব শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার জন্য লড়াইয়ে নামেন। যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-তে। ছয় ও সাতের দশকে বম্বেতে হওয়া ধর্মঘটের অন্যতম কান্ডারি এই দত্তা সামন্ত। কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে জিতে ১৯৭২ সালে মহারাষ্ট্র বিধানসভার সদস্য হন। কংগ্রেসের নেতা হলেও তাঁর আচরণের জন্য ‘জরুরি অবস্থা’-র সময় দত্তা সামন্তকে জেলে যেতে হয়। ১৯৭৭ সালে জনতা জমানায় জেল থেকে ছাড়া পেলে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
বিশেষত, আটের দশকের শুরুতে তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গ স্পর্শ করে। ওই সময় সামন্তের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা সক্ষম হয়েছিল উচ্চ হারে বেতন বাড়াতে। বিশেষত ‘প্রিমিয়ার অটোমোবাইলস’-এর কারখানার শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি দেখে কাপড়ের কলের শ্রমিকরাও দত্তা সামন্তের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। কাপড়ের কারখানার শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে ১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি সামন্তের নেতৃত্বে ডাকা ধর্মঘট অন্য মাত্রা পায়। ৬৫টি টেক্সটাইল কারখানার প্রায় আড়াই লক্ষ শ্রমিক শামিল হয়। ২০ মাসের জন্য টেক্সটাইল মিলগুলিতে ধর্মঘট চলে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-সহ বেশ কিছু নেতা সামন্তর জনপ্রিয়তাকে ভাল চোখে দেখেননি। ভয় পেয়েছিলেন কারণ যদি কাপড়ের কলগুলির শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মেনে নেয় তাহলে এই শ্রমিক নেতাটির জনপ্রিয়তা শুধু বাড়বে না, রেল, বন্দর প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রমিকরাও উৎসাহ পেয়ে যাবে ধর্মঘট করে বেতন বাড়িয়ে নিতে। ফলে কোনওরকম শ্রমনীতিগত কারণে নয়– পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারের দিক থেকেও সহমর্মিতার বদলে কঠোর মনোভাব অবলম্বন করা হয়। শিবসেনাও ধর্মঘটরত শ্রমিকদের
ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করতে থাকে। দীর্ঘ দিন ধর্মঘট চলায় শ্রমিকরাও উৎসাহ হারাচ্ছিল।
ধর্মঘটীদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতের জেরে ধর্মঘট ভাঙলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। বরং বহু শ্রমিক কাজ হারায়। দীর্ঘদিন চলা ধর্মঘট ব্যর্থ হওয়ায় দেশজুড়ে শ্রমিকদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে দিয়েছিল। ওই ধর্মঘটকে অজুহাত করে বেশ কিছু মিল মালিক বম্বে ছাড়েন। অনেকেই তখন মিলের জমিকে রিয়েল এস্টেটের কাজে ব্যবহার করেন।
ধর্মঘট ব্যর্থ হলেও ডাক্তার সাহাবের জনপ্রিয়তা কমেনি। এরপরেই ১৯৮৪ সালে লোকসভা ভোটে নির্দল প্রার্থী হয়েই তিনি ভোটে জেতেন। সেই নির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ায় কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতির হাওয়ায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস।
তবু সেই হাওয়ার বিপরীতে থাকা দত্তা সামন্তকে আটকাতে পারা যায়নি। তবে দত্তা সামন্তের জীবনের শেষ দিকটায় বরং কিছুটা কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছিল। দত্তা সামন্তর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কারা ছিলেন সেটা এখনও রহস্যই থেকে গিয়েছে। রিয়েল এস্টেট লবির কাছে ডাক্তার সাহাব ছিলেন মস্ত বিপদ। আবার প্রিমিয়ার পদ্মিনীর মতো কর্পোরেট বসের কাছে এই মানুষটি ছিলেন প্রতিবন্ধক। এদিকে, এককালে বন্ধু হলেও বাল ঠাকরে এবং তঁার দলবলের কাছে এই মানুষটা ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিলেন।
বিজেপি-শিবসেনা সরকার আশঙ্কা করেছিল, এই মানুষটা জঙ্গি শ্রমিক সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া তাঁর অস্তিত্বকে অর্থনৈতিক বাধা হিসাবেও সেই সময় দেখেছিলেন সংস্কারপন্থীরা।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
sidmukh12@gmail.com