shono
Advertisement

মোদির লালকেল্লার ভাষণ ও ভাগবতের ‘অখণ্ড ভারত’ভাবনার মিল কোথায়?

এতগুলো দেশ যদি একসঙ্গে ভারতকে বলে, ‘এসব হচ্ছেটা কী’, সরকার তাহলে কী উত্তর দেবে?
Posted: 06:59 PM Aug 17, 2022Updated: 06:59 PM Aug 17, 2022

প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্ট লালকেল্লা থেকে আগামী সিকি শতকের যে ‘রোডম্যাপ’ জনমানসে এঁকে দিলেন, তার সঙ্গে মোহন ভাগবতের ‘অখণ্ড ভারত’ ও বারাণসীর শঙ্করাচার্য পীঠাধ্যক্ষ আনন্দ স্বরূপের ‘হিন্দু ভারত’-এর খসড়া সংবিধানের মিল না-থাকলেও তেমন বিরোধও কিন্তু নেই। কলম ধরছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

ভাবছি, এতগুলো দেশ যদি একসঙ্গে ভারতকে বলে, ‘এসব হচ্ছেটা কী’, সরকার তাহলে কী উত্তর দেবে? কিংবা যদি জানতে চায়, প্রকাশ্যে যা ঘটছে, তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কেন কিছু বলা হচ্ছে না, তাহলে কী সাফাই দেবে? হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবকদের কাল্পনিক জগৎ সৃষ্টির দায় অবশ্যই সরকারের উপর বর্তায় না। কিন্তু তাই বলে কল্পনাপ্রসূত সেই দাবি, যা দেশে তো বটেই, বিদেশেও অস্বস্তির হাওয়া বইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, তাকে সরকারিভাবে হাস্যকর বা অবান্তরও কি বলা যায় না? এ তো নিতান্তই এক মৃদু তিরস্কার!

আরও ভাবছি, কোনও এক ‘শঙ্করাচার্য পীঠাধ্যক্ষ’ ও কিছু হিন্দু ধর্মগুরুর আকাশকুসুম কল্পনা সরকার অর্বাচীনের প্রলাপ বলে প্রত্যাখ্যান করতেই পারে। হয়তো উপেক্ষাও। কিন্তু সেই একই ‘স্বপ্ন’ যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান বারবার দেখাতে থাকেন, তখন তা উপেক্ষণীয় হতে পারে কি? বিশেষ করে স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ পালনের সন্ধিক্ষণে? ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ এই দুই সমগোত্রীয় দাবি ও চাহিদার দরুন ভিন্ন মাত্রা পেয়ে গেল।

[আরও পড়ুন: স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও বড়লোকের ঢাক তৈরি হয় গরিবের চামড়ায়!

প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্ট লালকেল্লা থেকে আগামী সিকি শতকের যে ‘রোডম্যাপ’ জনমানসে এঁকে দিলেন, তার সঙ্গে মোহন ভাগবতের ‘অখণ্ড ভারত’ ও বারাণসীর শঙ্করাচার্য পীঠাধ্যক্ষ আনন্দ স্বরূপের ‘হিন্দু ভারত’-এর খসড়া সংবিধানের আপাতগ্রাহ্য কোনও মিল হয়তো নেই। কিন্তু বিরোধও যে নেই, তা স্পষ্ট। নেই বলেই আরএসএস-এর ‘অখণ্ড ভারত’ গড়ার আহ্বানের বিরুদ্ধে বিজেপির কোনও প্রধানমন্ত্রী কিংবা কোনও সভাপতি আজ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে একটিবারের জন্যও মুখ খোলেননি। বরং প্রায় ১০০ বছর ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের যে-কথা সংঘ বলে আসছে, অসম্ভব জেনেও যে ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের সংকল্প থেকে বিচ্যুত না হওয়ার অঙ্গীকার ও দৃঢ়তা দেখিয়ে যাচ্ছে, মোদির বিজেপি সেই আদর্শেই আগুয়ান। তাই, প্রতিবেশী সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো যদি ভারতকে বাস্তবিক চেপে ধরে, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সরকার সেটাই করবে যা নূপুর শর্মাকে আড়াল করতে করেছিল। অর্বাচীন বা বালখিল্য আচরণের সঙ্গে তুলনা করে বলবে- ওই মতবাদ বা ধারণা সরকারের নয়। সরকার কোনও স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অধিকার হরণে আগ্রহী নয়। জমির জন্যও লালায়িত নয়।

মোহন-বাণীতে বারবার যে-অখণ্ডতা উচ্চারিত, সেই চেতনার জন্মদাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। অখণ্ড ভারতের আঁতুড় ওই চেতনা। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়েও ভারত বিভাজনের বিরোধিতার নমুনা হিসাবে আরএসএস ১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট থেকে এই দিনটি ‘অখণ্ড ভারত দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে। ১৯৫৩ সালে জনসংঘ ‘একীকরণ ভারত’-এর ডাক দিয়ে এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল। ১৯৬৫ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সেই প্রস্তাব পুনর্গঠিত হয়েছিল দীনদয়াল উপাধ্যায়ের আগ্রহ ও উদ্যোগে। জন সংঘ তা গ্রহণও করেছিল।

মোহন ভাগবত আজ যে-কথা বলছেন, তাতে সেই অর্থে নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু তবু তা মাত্রাধিক গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে মোদির আমলে দেশের সামাজিক বিন্যাস ও ধর্মীয় মেরুকরণ ভিন্নরূপ গ্রহণ করেছে বলে। এই নবরূপী ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিরঙ্কুশ প্রতিষ্ঠার তাগিদে মোহন ভাগবত অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নতুনভাবে দেখিয়ে ১৪ আগস্ট বলেন, ‘স্বপ্নপূরণের পথে একমাত্র বাধা ভয়। ভয় যেদিন কাটানো যাবে, সেদিনই অখণ্ড ভারত গঠন সম্ভবপর হবে।’

সেই ভারতের বিন্যাস হবে, পশ্চিমে ‘উপগণথান’ (আফগানিস্তান)- ‘কুভ নগর’ (কাবুল) যার রাজধানী, এবং ‘পুরুষপুর’ (পেশোয়ার) ও ‘মূলস্তান’-সহ (মুলতান) সমগ্র পাকিস্তান। পুবে বাংলাদেশ-সহ গোটা ‘ব্রহ্মদেশ’ (মায়ানমার) ও দক্ষিণে ‘সিংহলদ্বীপ’( শ্রীলঙ্কা)। উত্তরে ভুটান ও নেপাল পেরিয়ে ‘ত্রিবিস্তপ’ বা তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি হবে অখণ্ড ভারতের ভৌগোলিক সীমানা।

এই মানচিত্র অবশ্যই এক কষ্টকল্পনা। তবু সেই কল্পনায় পাখা জুড়েছেন দেশের সনাতন ধর্মের ৩০ জন পণ্ডিত। এই ধর্মগুরুরা অখণ্ড ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণা করে সেই দেশের খসড়া সংবিধানের কিছু নমুনা পেশ করেছেন। স্বাধীনতা দিবসের দু’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন কেন্দ্র বারাণসীতে রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে প্রকাশ্যে তাঁরা জানিয়েছেন- খসড়া সংবিধানে অখণ্ড ভারতে বসবাসকারী মুসলমান ও খ্রিস্টানরা যাবতীয় নাগরিক সুবিধা ভোগ করলেও তাদের ভোটাধিকার থাকবে না। অখণ্ড ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে সরিয়ে আনা হবে বারাণসীতে। সেখানে তৈরি হবে নতুন সংসদ ভবন। ভোটের বয়স ধার্য হবে ১৬ বছর থেকে। বর্ণপ্রথা মেনে দেশ চালিত হবে। ব্রিটিশ আমলের সব আইন বাতিল করে ফিরিয়ে আনা হবে ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের বিচার ব্যবস্থা। জ্যোতিষ, গণিত, আয়ুর্বেদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান শিক্ষায় জোর দেওয়া হবে। আগামী বছর মাঘী পূর্ণিমায় প্রয়াগ সঙ্গমে ধর্ম সংসদে পেশ হবে চূড়ান্ত খসড়া সংবিধান।

মজার বিষয়, একদিনের ব্যবধানে প্রধানমন্ত্রী ও মোহন ভাগবত দু’জনেই আগামী ২৫ বছরের জন্য ভারতের ‘রোডম্যাপ’ চিত্রিত করলেন। মোদি উন্নত ভারত গড়ার লক্ষ্যে পাঁচ সংকল্প-রক্ষার বার্তা দিলেন। আর, ভাগবত বললেন, ‘নিজেই নিজের কাছে জানতে চান, যে-দেশের ব্যাপ্তি ছিল এত বিশাল, আজ তা কেন সংকুচিত? জিজ্ঞেস করুন, সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনির জন্মস্থান কেন বিদেশে (পাকিস্তান)?’ ভাগবত শুনিয়েছেন, ‘দেশের জন্য এক হয়ে আমরা যদি বাঁচতে ও মরতে শিখি, তাহলে অতি দ্রুত অখণ্ড ভারত গঠনের কাজ শেষ হবে। এখন যে-গতিতে দেশ চলছে, একটু গতি বাড়ালে ২০-২৫ বছরের মধ্যে তা আয়ত্ত হবে। গতি আরও বাড়ালে অর্ধেক সময় কমে যাবে।’

অবাস্তব ও কষ্টকল্পিত এই ভারতের বিস্তারলাভ অসম্ভব জেনেও কেন তা জিইয়ে রেখে সময় সময় নতুন বাতাস দেওয়া হয় সরকারি প্রশ্রয় ও উৎসাহে? প্রশ্নটি সংগত। উত্তরও সহজে অনুমেয়। ভারতকে অঘোষিত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে এই ‘প্যাশন’ ভাগবত-মোদি জুটিকে জাগিয়ে রাখতেই হবে। মোহন ভাগবত ও নরেন্দ্র মোদির বয়সের ফারাক মাত্র ছ’দিন। সংঘ সংস্পর্শ দু’জনেরই এক সময়। ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার বছরে সেপ্টেম্বর মাসে ভাগবত ও মোদির বয়সও হবে ৭৫। স্বঘোষিত নিয়ম মেনে দু’জনে অবসর নিন বা না-নিন, আজন্মলালিত আদর্শ ও বিশ্বাস অনুযায়ী এই প্যাশনে তাঁরা হাওয়া দিয়েই যাবেন।

ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করে তোলার রাজনীতি ও সমাজনীতি এটাই। তাঁরা নিজেরাও বিলক্ষণ জানেন, অখণ্ড ভারত চিরদিন অধরাই থাকবে। এ-কথাও জানেন, যে-বিশ্বাস ও আদর্শে তাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, অখণ্ড ভারত বাস্তবায়িত হলে তা ভন্ডুল হয়ে যাবে। মুসলমান-প্রাধান্য বৃদ্ধি পাবে, হিন্দুরা হবে কোণঠাসা। কিন্তু তবু, সব জেনেশুনেও মুসলমানদের অঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশে অখণ্ড ভারতে মুসলমান-খ্রিস্টানদের ভোটাধিকার হরণের গাজর ঝুলিয়ে এগনো ছাড়া তাঁদের কাছে দ্বিতীয় উপায় নেই।

সিএএ, এনআরসি, ৩৭০, হিজাব, হালাল, আজান, বুলডোজার, ইউএপিএ, এনআইএ, দেশদ্রোহ আইনের কঠোর প্রয়োগ এই ‘ন্যারেটিভ’ অনুযায়ী বিশ্লেষণ করুন, দেখবেন উত্তরটা মিলে যাচ্ছে। কোনওটিই বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এর পাশে রাখুন তেরঙ্গা তোলার প্রতিযোগিতা, ইডি-সিবিআই-আয়কর বিভাগের অতি সক্রিয়তা, ইতিহাস স্বীকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অসম্মান, ইতিহাস বদলের মরিয়া প্রচেষ্টাকে। বিরোধীহীন ভারত ও নখ-দন্তহীন সদা-সন্ত্রস্ত মুসলমান-অস্তিত্ব, অঙ্কটা জলের মতো সহজ হয়ে যাবে।

[আরও পড়ুন: ঝোপ বুঝে কোপ, আগামী দিনে বিজেপির ‘টার্গেট’ দাক্ষিণাত্য]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement