বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠলেও মানতে রাজি নয় ইউনুস সরকার। কিন্তু গর্জে উঠলেন পদ্মাপাড়ের কবি, মানবাধিকার ও পরিবেশ কর্মী ফরহাদ মজহার। সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে সরাসরি ইউনুসকে প্রশ্ন করলেন---'রাজা তোর কাপড় কোথায়?' সরকারকে তুষ্ট না করে ধর্ম ও উগ্র জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে উপনিষদ কথিত 'ঈশ্বর মুখপাত্র কবি'র দায়িত্ব পালন করলেন ফরহাদ। লিখছেন কিশোর ঘোষ।
ঢাকা। ২০১১। সেপ্টেম্বর। সকাল। ফরহাদ (মজহার) ভাইয়ের বাড়িতে ঢুকেই ধাক্কা! 'এবাদতনামা'র কবির বৈঠকখানায় সরস্বতী মূর্তি! মাটির, মেটে রঙের। উদারপন্থী প্রগতিশীলতার চিহ্ন? দেখনদারি? মূর্তি দেখা মাত্র হাজার প্রশ্ন ডিম পাড়ছিল সন্দেহবাতিক মাথার ভিতর। আসল কথা, আজ এক দশকেরও বেশি পরে সেই সরস্বতীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল! কীভাবে?
সবাই জানি, এখন ভারত-বাংলাদেশ নিয়ে ঘৃণার খেলা চলছে। এই খেলা বন্ধ হয় না, হয়নি, চলতে থাকে এবং থাকবে। কখনও পাকিস্তান, চিন, কখন ধর্ম-বর্ণ, কখনও দলীয় রাজনীতি, কখনও মোহন-ইস্ট, এমনকী মেসি-রোনাল্ডো, শাহরুখ-সলমানের দোহাই দিয়ে ঘৃণা খেলায় ওস্তাদ আমরা। যেহেতু মানব সভ্যতার প্রিয় 'টাইম পাস' হল ঘৃণার খেলা। মুচমুচে পপকর্নের মতো সুস্বাদু ঘৃণা। জীবন একটা উত্তেজক সিনেমা। সেই সিনেমা উপভোগ করতে করতে ঘৃণা ভাজা চিবোচ্ছি আমরা!
এমন বিন্দাস ফুর্তির মাঝে কেউ যদি মানবিক প্রশ্ন তোলে---একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ঘৃণা আদৌ কতটা জরুরি? সভ্য মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তো লাগে ওই ভাত-কাপড়-ছাদ। আপনি যদি সস্তা রাজনীতিবিদ কিংবা নির্মম অস্ত্র ব্যবসায়ী হন, কেবল তবেই ঘৃণার প্রয়োজন পড়বে আপনার। তাই নয় কী?
সেদিন বাংলাদশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুসের সামনে কতকটা এমন প্রশ্নই তুলেছেন কবি, দার্শনিক, মানবাধিকার ও পরিবেশ কর্মী ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, "চিন্ময়কষ্ণ দাসের কথা আমি শুনেছি৷ কখনও তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী মনে হয়নি৷ তাঁর সঙ্গে আমার মতের অমিল হতে পারে, তার মানে এই নয় যে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ক্ষতিকারক৷ এর আগে চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করেছে৷ তাঁরও তো নিজের বক্তব্য রাখার অধিকার আছে৷"
ফরহাদের এই বক্তব্যে দুই গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। প্রথমত, ভিন্নমত মানেই রাষ্ট্র বিরোধিতা নয়। দ্বিতীয়ত, যে চিন্ময়কৃষ্ণ আজকে রাষ্ট্রদ্রোহী, তাঁকেই অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারও করেছে। এই অভিযোগ গুরুতর। এখানেই থেমে যাননি বঙ্গভাষার বিশিষ্ট কবি। যে সংখ্যালঘু অত্যাচার নিয়ে সংঘাত, যে বিষয়টিকে বার বার অস্বীকার করেছে ইউনুস সরকার, সেই বিষয়ে দ্বিধহীন ফরহাদ কার্যত হাঁটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। তিনি বলেন, "সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই৷ গরিব মানুষের উপরে আঘাত নেমে আসছে, তাঁদের জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে৷ আওয়ামি লিগ যে কুকীর্তিগুলো করেছে, এখন অন্য দল করছে৷ এই তো কথা৷ ফলে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি, একথা বলা যাবে না৷"
দুই বাংলার সংবাদমাধ্যমে ফরহাদের নির্ভীক, সত্যময় বক্তব্যের প্রতিবেদন পড়া মাত্র ২০১১ সালের ঢাকা সফরে ফিরে গিয়েছিলাম আমি। সেই সেপ্টেম্বর, সকাল। আমি, শিমুল (সালাহউদ্দিন) এবং অরণ্য (বন্দ্যোপাধ্যায়) ঢুকলাম কবির বাড়িতে। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন ফরহাদ। প্রাথমিক আলাপের পর তিন তরুণের আবদারে 'এবাদতনামা' থেকে কবিতা পড়লেন। অসামান্য সেই সব পংক্তিরা---"না, আমি মোঙ্গল নই, নই তুর্কি, মুঘলকি বীর/ অহংকারী আর্য নই, নই খাস প্রাচীন দ্রাবিড়,/ ভূমিষ্ঠ হইনি আমি ব্রাহ্মণ বা মৌলবীর ঘরে/ আমি নয়া অভ্যুদয় ভূমণ্ডলে মাটির অন্তরে।" এমনকী বইটি উপহারও দিলেন আমাকে।
ঢাকায় তাঁর বাড়িতে কবি ফরহাদ মজহার, অরণ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শিমুল সালহউদ্দিন এবং প্রতিবেদক। পিছনে সেই সরস্বতী মূর্তি।
পালটা কবিতা শুনতে চাইলেন। 'উট-পালকের ডায়েরি' থেকে পড়লাম আমি। তাঁকে উপহার দিলাম আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কথা হল তাঁর 'নয়া কৃষি আন্দোলন' নিয়ে। মহীরূহ মানুষটির সঙ্গে আড্ডায় দুপুর গড়াল। নয়া কৃষি আন্দোলনের ফসল লাল চালের ভাত, জৈব সারে উৎপাদিত সবজি দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম আমরা। প্রায় বিকেলের প্রান্তে ওঁর বাসা ছেড়ে ঢাকা সফরে আমার অস্থায়ী ঠিকানা শিমুলের বাংলামোটরের ফ্ল্যাটে পৌঁছাই সেদিন।
যদিও মন পড়েছিল ফরহাদ ভাইয়ের বাসায়। কেবলই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বৈঠকখানার সরস্বতী মূর্তি। এবং অবধারিত প্রশ্ন খচখচ করছিল মাথার ভিতর---প্রগতিশীলতার চিহ্ন? দেখনদারি? তা যে নয়, ইউনুসের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভীক বক্তব্যে সেকথা বুঝিয়ে দিয়েছেন কবি। মনে করিয়ে দিয়েছেন এপারের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে, কার্যত 'উলঙ্গ রাজা'র দিকে শিশুর সারল্যে ছুড়ে দিয়েছেন স্বচ্ছ, ধারাল কাচের মতো প্রশ্ন। আর সেই মুহূর্তে ফরহাদ ভাইয়ের বৈঠকখানায় এবং আমার স্মৃতির ভিতরে অধিষ্ঠিত মাটির, মেটে রঙের সেই সরস্বতী মূর্তিটি প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে! একজন কবির থেকে এমন সত্যবাদীতাই তো কাম্য। এই কবিকেই তো 'ঈশ্বরের মুখপাত্র' বলেছিল উপনিষদ।
অতএব, এই অবসরে ফরহাদ ভাইকে প্রণাম, একজন কবি হিসেবে, মানুষ হিসেবে। যে কবি 'স্বার্থপর' নয়, রাষ্ট্রপ্রধানের ধামাধরা 'পুরস্কার লোভী' নয়। এবং সেই মানুষ, যার বেঁচে থাকার জন্য ঘৃণার প্রয়োজন পড়ে না। ভাত-কাপড়-ছাদ হলেই চলে। সঙ্গে বড়জোর ফুল-পাখি-পাহাড়-নদী-নক্ষত্রের চাহিদা।