shono
Advertisement
Kolkata's Hawkers

সমান্তরাল অর্থনীতির সূত্রধার

মহানগরে ফেরিওয়ালারা মল সংস্কৃতির বিপরীতে ‘বিকল্প’ অর্থনৈতিক ধারা চালু রেখেছেন।
Published By: Kishore GhoshPosted: 10:48 PM Dec 08, 2024Updated: 10:48 PM Dec 08, 2024

‘আইএলও’ জানাচ্ছে– হকারি বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষকে কর্মসংস্থান প্রদান করে ও উন্নয়নশীল দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র হিসাবে জিডিপি-তে প্রায় ২৫-৪০ শতাংশ অবদান রাখে। এই মহানগরে ফেরিওয়ালারা মল সংস্কৃতির বিপরীতে ‘বিকল্প’ অর্থনৈতিক ধারা চালু রেখেছেন। তা’ বলে ফুটপাত-জুড়ে বেআইনি ও নিয়মবিরুদ্ধ বিকিকিনিকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্ন নেই। লিখেছেন অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 

Advertisement

‘চিনা সিল্ক, চিনা সিল্ক’– অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া মৃণাল সেনের ছায়াছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ এই ধ্বনিতে ফুটিয়ে তুলেছিল একজন ভিনদেশি হকারের জীবনচিত্র। ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল আর-একটি সিনেমা– ‘দ্য রানিং হকার’। সেখানেও পরিচালকদ্বয় (চন্দন বিশ্বাস ও অভিজ্ঞান সরকার) ট্রেনে-বাসের ফেরিওয়ালাদের রুজির প্রশ্নটিকে সাজিয়েছিলেন বৃহৎ পুঁজির শপিং মল সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের বিন্যাসে। চলতি বছরেই তৈরি হয়েছে ‘মন পতঙ্গ’ নামের আর-একটি সিনেমা (পরিচালক রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি), যা ফুটপাতবাসীদের জীবনের কথা তুলে ধরেছে– যেখানে ‘ব্যক্তিগত পরিসর’ বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।

কলকাতা শহরে ফুটপাতের ফেরিওয়ালার সংখ্যা নিতান্ত মামুলি নয়। কেএমসি-র সাম্প্রতিকতম সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তা প্রায় ৫৪,১৭৮। যদিও বিভিন্ন হকার’স ইউনিয়নের দাবি মোতাবেক, বাস্তব সংখ্যাটা প্রায় তিন-চারগুণ। এটা কেবল সংখ্যা নয়, প্রত্যেকটা সংখ্যার অন্তরালে আছে এক-একটি পরিবারের অস্তিত্বের প্রশ্ন। রাজনীতির ময়দানে ফুটপাত কেবল মধ্যরাত্রেই নয়, যখন-তখন বদলে যায়। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ব্যাপক সাফল্য পেলেও, তাদের পুরসভাভিত্তিক ফলাফল আশাপ্রদ ছিল না, এমন কথা দলের অন্দরেও উঠেছিল। কলকাতা থেকে কোচবিহার অবধি সর্বত্র ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করে নাগরিকের মধ্যবিত্ত মনের কাছাকাছি আসার একটা প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। হকারদের ফুটপাত দখলকে কেন্দ্র করে শহুরে মানুষের ক্ষোভ নতুন নয়। বাস্তবিক পুজোর সময় আমজনতার হঁাটাচলা করা সত্যিই মুশকিল হয়ে ওঠে।

গড়িয়াহাট, ভিআইপি রোড, বউবাজার সর্বত্র ধরা পড়ে একই ছবি। সারি-সারি অস্থায়ী দোকান আর বিজ্ঞাপনী গেট ঘিরে ফেলে সমস্ত ফুটপাতকে। লম্বা যানজটে আটকা পড়ে থাকে জরুরি পরিষেবাও। লাগাতার হর্নে কান ঝালাপালা হয়ে গেলেও অবস্থার ইতরবিশেষ হয় না। অভিযোগ, ফি-বছর একই চিত্র, কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন উদাসীন। বছরের অন্যান্য সময়ে অবস্থা কিছুটা ফেরে ঠিকই, তবে তা কহতব্য কিছু নয়। ত্রিপল, বঁাশ আর ধোঁয়া হল কলকাতার ফুটপাতের নিত্যদিনের চেহারা ও সংস্থান।

কিন্তু উপায় কী? গণতন্ত্রে ক্ষমতার রাজনীতি বড় বালাই। ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগ বিরোধীদের সক্রিয়তায় অনেক সময় ধামাচাপা পড়ে যায়। একদা কংগ্রেস যখন ফুটপাত-উদ্ধারে সক্রিয় হয়েছিল, তখন বাম দলগুলি রে-রে করে এসেছিল, আবার যখন বামফ্রন্ট ‘অপারেশন সানশাইন’ চালিয়েছিল, তখনও প্রতিবাদ উঠেছিল। সম্প্রতি, ত্রিধারা কনস্ট্রাকশনের একটি মামলায় কলেজ স্ট্রিট এলাকার ফেরিওয়ালাদের উচ্ছেদ বিষয়ে হাই কোর্ট কেএমসি-কে রিপোর্ট জমা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এপ্রিল মাসের মিটিং থেকে জানা গেল, নিয়ম হল– যেখানে ফুটপাতের দৈর্ঘ্য পঁাচ ফুটের বেশি, সেখানে হকারি করা যাবে, এবং কলেজস্ট্রিট সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। ‘স্ট্রিট ভেন্ডর অ্যাক্ট ২০১৪’ ও ‘দ‌্য ওয়েস্ট বেঙ্গল আর্বান স্ট্রিট ভেন্ডরস( প্রোটেকশন অফ লাইভলিহুড অ‌্যান্ড রেগুলেশন অফ স্ট্রিট ভেন্ডিং) রুল্‌স ২০১৮’ অনুযায়ী, ফুটপাতের এক-তৃতীয়াংশ হকারির জন্য অনুমোদিত থাকে ও বাকিটা পথচারীদের জন্য সংরক্ষিত। নজরটান, এ-বছর জানুয়ারি মাসে ‘নন-ভেন্ডিং জোন’-এর একটি প্রাথমিক তালিকাও প্রকাশিত হয়। সেখানে ১৮৯২টি রাস্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, অর্থাৎ সেখানে হকারি ‘নিষিদ্ধ’। এবারে যদি কেউ সেই স্থান দখল করে বসে, তাহলে কী হবে! বুলডোজারই তখন ভবিতব্য?

রাজ্যের সরকার ফেরিওয়ালাদের প্রতি আন্তরিক। সরকারের প্রথম পঁাচ বছরে ‘চলমান হকার’ শিরোনামে বৈধতা প্রদান থেকে পাকা লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা অবধি ঘটনার সাক্ষী মানুষ হয়েছে। ভোটের একটা বড় কারণ হলেও– একমাত্র নয়। আর-একটি হল, ভারতের অর্থনীতিতে ফেরিওয়ালাদের অবদান। এটা যেন কংক্রিটের রাস্তায় একটি অঙ্কুরোদ্‌গম। যাকে বলা হয়, ‘ফেরিওয়ালার অর্থনীতি’। তাই এ ব্যাপারে, রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় সরকারই সচেতন। সেজন্যই তো হরদীপ সিং পুরি জানিয়েছিলেন, নতুন ভারতে ফেরিওয়ালারা দখলদার নয়, তঁারা স্ব-নিযুক্ত কর্মী। কেন্দ্রের তরফেও হকারদের জন্য মাইক্রো-ক্রেডিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার নাম ‘পিএম স্ট্রিট ভেন্ডর আত্মনির্ভর নিধি’। রাজ্যও ফেরিওয়ালাদের জন্য নানা জনমুখী প্রকল্প এনেছে– তঁাদের ‘স্বাস্থ্যসাথী’-র অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এমনকী কোভিডের সময় আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু রাজ্যজুড়ে যে-উচ্ছেদ হল এবার, কী হবে ওই মানুষগুলোর, যঁারা এত দিন বিবিধ পণ্যের ঠেলাগাড়ি নিয়ে উপার্জনের আশায় রাস্তায় বসতেন? ঝাল-চুরমুর থেকে সালোয়ার, বিবিধ টাটকা সবজি থেকে ফল, অথবা গরম ভুট্টা থেকে ঠান্ডা শরবত নিয়ে প্রবল রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে অপেক্ষা করতেন মধ্যবিত্তর পদধ্বনি। রোজগারই তো অসাম্য ও দারিদ্রের অমোচনীয় ক্ষুধাকে ফুটন্ত জলে অশ্বের টগবগ শব্দে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পরাজিত করে দেয়। যে-ত্রিপল শহরের উচ্চশ্রেণির কাছে আবর্জনা, সেটাই তো এই শ্রেণির মানুষের কাছে স্বাধীনতার পতাকা, অশ্রুভরা চোখে আশ্বাসের রুমাল।

বিস্মৃত হলে চলবে না, হকাররা সমাজে একটি ‘সমান্তরাল অর্থনীতি ব্যবস্থা’ চালু রেখেছেন। কম আয়ের গ্রাহকদের কাছে এঁরা সাশ্রয়ী ও সামর্থ্যযোগ্য খাবার, বস্ত্র, গৃহস্থালি দ্রব্য ও ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র তুলে দেন। এছাড়া কম-দক্ষ শ্রমিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস ও কর্মসংস্থান হিসাবে কাজ করে এই হকারি। শ্রম শুধুমাত্র মজুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনও অনড় বিষয় নয়, তা স্ব-উদ্যোগ ও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলির শ্রমকেও গণনা করে। রাস্তার বিক্রেতারা আদতে হলেন ‘ছোট উদ্যোক্তা’, যঁারা নানারকমের দৈনন্দিন পণ্য ও পরিষেবা বিক্রি করেন।

পরিবেশবান্ধব হিসাবেও এর গুরুত্ব ফেলনা নয়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত, মৌসুমি ও জৈব পণ্যের পশরা এখানে সহজলভ্য। গৃহসজ্জার জন্য গাছপালা থেকে জ্যান্ত মাছ তার দৃষ্টান্ত। বহু অঞ্চলের বহু মানুষের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্র হিসাবেও এর জুড়ি মেলা ভার। ‘ইন্টারন‌্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’ জানাচ্ছে যে, হকারি বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষকে কর্মসংস্থান প্রদান করেছে ও উন্নয়নশীল দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্র হিসাবে জিডিপি-তে প্রায় ২৫-৪০ শতাংশ অবদান রাখে।

কোভিডের আগের তথ্য বলছে, তখন নাকি টার্নওভার ছিল প্রতিদিন প্রায় ৮০ কোটি টাকা। ‘ন্যাশনাল হকার ফেডারেশন’-এর তথ্যানুযায়ী, ৫০ শতাংশ হকার খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতেন, আর ২০ শতাংশ জামাকাপড়, প্লাস্টিক পণ্য, ব্র্যান্ডবিহীন ক্রকারি-কাটলারি এবং গৃহস্থালি পণ্যের মাধ্যমে টার্নওভার দিতেন। মেয়েদের যোগদানও এখানে নজরকাড়া। ‘ইন্টারন‌্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর ‘উইমেন ইন ইনফর্মাল এমপ্লয়মেন্ট ২০২০’-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে মোট ১১.৮ শতাংশ ফেরিওয়ালা আছেন, যার মধ্যে ১.২ শতাংশ মহিলা। ৩৫-৫৪ বছরের মহিলার সংখ্যা এখানে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৫৩ শতাংশ। এঁদের মধ্যে শিক্ষার হার কম, প্রায় ৬৩ শতাংশ মহিলাই প্রাথমিক শিক্ষার দরজা পেরতে পারেননি, মাত্র ২.৩ শতাংশ স্নাতক। রিপোর্ট জানাচ্ছে– মহিলা ও পুরুষের রোজগার যথাক্রমে ঘণ্টায় মাত্র ২৯ টাকা ও ৪০ টাকা। তবুও সপ্তাহে ৫৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন প্রায় ৪৫ শতাংশ মহিলা। এঁরাই কিন্তু প্রবল উদ্যমে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ক্রমবর্ধমান শপিং মলগুলির পাশাপাশি অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের ‘বিকল্প’ পথকে উন্মোচিত করে রেখেছেন।

সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সমস্যা ৫৪,১৭৮ জনকে নিয়ে নয়, তঁাদের মধ্যে থেকে এমন ১৪ হাজার জনকে নিয়ে, যঁারা নানাবিধ বেআইনি ও নিয়মবিরুদ্ধভাবে ব্যবসা করছেন। জিপিএস ট্যাগিং করে ও বিস্তারিত সমীক্ষার মাধ্যমে এসব ত্রুটি ধরা পড়েছে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তবে পুরসভা জানিয়েছিল যে, টাউন ভেন্ডিং কমিটির বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনা উত্থাপিত হবে। বৈধ হকারদের যেমন কোনও ক্ষতি হবে না, তেমনই অসাধু হকারদের বিষয়ে পুরসভা যে কড়া সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ও স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে।

হকারব্যবস্থাকে সমস্যা হিসাবেও যেমন দেখা যায়, তেমনই সমান্তরাল অর্থব্যবস্থার দৃষ্টান্তও এটি। সরকার এখানে রজ্জুনর্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সিদ্ধান্ত, যখন যাই হোক, কেউ বলবে ‘জনতোষণ’, আর কেউ ‘জনমুখী’। আশা এটুকুই যে, এইবারে সরকারের মানবিক প্রয়াসে কারও চোখে জল ঝরবে না, আবার মধ্যবিত্ত নাগরিকের সমস্যার সমাধানের সূত্রটিও মিলবে। মনে পড়ে একটা কবিতা, কবি লিখেছেন, “ন্যাংটো ছেলে আকাশে হাত বাড়ায়/ যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা/ ফুটপাথে আজ লেগেছে জোছনা/ চঁাদ হেসে তার কপালে চুমু খায়/ লুকিয়ে মোছেন চোখের জল, মা।”
পুনশ্চ সরকার কিন্তু মা, মাটি ও মানুষেরই।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, বাসন্তী দেবী কলেজ
rana.ardh1024@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কলকাতা শহরে ফুটপাতের ফেরিওয়ালার সংখ্যা নিতান্ত মামুলি নয়।
  • বাস্তবিক পুজোর সময় আমজনতার হঁাটাচলা করা সত্যিই মুশকিল হয়ে ওঠে।
Advertisement