দর্শক গল্প চেনেন, চরিত্র চেনেন; কিন্তু দক্ষ, সাবলীল, সময়োপযোগী উপস্থাপনা কোনও তুলনায় আসার সুযোগ দিল না। জাস্ট ভালো লেগে গেল নৈহাটি নাট্য সমন্বয়ের ‘বসন্ত বিলাপ’। লিখছেন কুণাল ঘোষ।
বহুরূপী না টেক্কা, পুষ্পা টু না খাদান, দেবের ছবি না কি শিবপ্রসাদের; বড়পর্দার নানা দৌড় ও চর্চার মধ্যেই মঞ্চে আরেকটি বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। সিনেমায় টাকা, গ্ল্যামার, প্রচার বেশি। কিন্তু শিল্পের স্বতন্ত্র ঘরানা ও উপাদানগুণে নিঃশব্দে দর্শকদের আকর্ষণ করছে এই উদ্যোগ। আমার আজকের আলোচ্য নৈহাটি নাট্য সমন্বয়ের ‘বসন্ত বিলাপ’, বিখ্যাত ছায়াছবির সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তার নাট্য সংস্করণ। বুধবার সন্ধ্যায় দেখলাম অ্যাকাডেমি হলে।
বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা কমেডি ছবি ‘বসন্ত বিলাপ’। এতগুলো চরিত্র, এত বৈচিত্র, এত গতি এবং তার চেয়ে বড় কথা, দর্শকদের মনে গেঁথে থাকা এক একটি চরিত্রে এক একজন হেভিওয়েট অভিনেতা; এই ছায়াজনিত চাপ অতিক্রম করে মঞ্চ সংস্করণ সহজ ছিল না এবং আরও কঠিন ছিল দর্শকাসন থেকে বারবার স্বতঃস্ফূর্ত করতালি আদায় করে নেওয়া। নাটকের টিম এই প্রশ্নে একশো শতাংশ সফল। দর্শক গল্প চেনেন, চরিত্র চেনেন; কিন্তু দক্ষ, সাবলীল, সময়োপযোগী উপস্থাপনা কোনও তুলনায় আসার সুযোগ দিল না। জাস্ট ভালো লেগে গেল।
আমি নাট্য বিশেষজ্ঞ নই। তবে দর্শক বটে। ব্রাত্য বসুর নাটকের অনুরাগী। ব্রাত্য অলরাউন্ডার এবং সেরা। কৌশিক সেন-সহ বহু বিশিষ্টর কাজ দেখি। দেবশঙ্কর হালদারকে দেখে সম্মোহিত হই। গৌতম হালদারের ম্যানারিজম দেখলে মুগ্ধতা ঘিরে রাখে। কিন্তু এই তারকাদের মধ্যে নজর টেনে নিচ্ছেন আরেকজন, পার্থ ভৌমিক, সফল রাজনীতিবিদের পরিচয়কে পাল্লা দিয়ে নাটকের মঞ্চে, কখনও অভিনেতা, কখনও টিম লিডার হিসাবে।
জনপ্রিয় সিনেমা যখন দর্শকের মনে দীর্ঘমেয়াদি ছাপ ফেলে দেয়, তখন তাকে মঞ্চে আনা বেশ কঠিন। এই কঠিন কাজটা করার নেশায় পেয়েছে পার্থ ভৌমিকদের। ওঁদের ‘দাদার কীর্তি’ বেশ ভালো হয়েছিল। আরও কাজ চলছে। এবং ‘বসন্ত বিলাপ’ দারুণ লাগল। একই পাড়ায় চার বন্ধুর সঙ্গে মহিলাদের হস্টেলের রেষারেষি, উদোম ঝগড়া, শেষে গুটি গুটি পায়ে প্রেমের প্রবেশ; গল্প, মজা, অভিনয়গুণ, শব্দ ও আবহ প্রেক্ষাপট, আলো, গানের ব্যবহার সবটাই ভারি চমৎকার। পরিস্থিতিগত সামান্য রদবদল একদম মানানসই।
‘বসন্ত বিলাপ’ রোম্যান্টিক কমেডি, অধুনা রমেডি ঘরানার। কাহিনি, চিত্রনাট্য কমেডিময়। ছবিতে তার সঙ্গে তিন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তিন বাঘা অভিনেতা। গুপ্তর চরিত্রে রবি ঘোষ, লালু অনুপকুমার, সিধু চিন্ময় রায়। তাঁরা পারফরম্যান্সে আকাশচুম্বী। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম রবিবাবুর চরিত্রে ভাস্কর মুখোপাধ্যায় কী অসাধারণ অভিনয়টা করে গেলেন আগাগোড়া। চিন্ময়ের চরিত্রটিতে সায়ন্তন মৈত্র, অনুপকুমারের চরিত্রে বিশ্বজিৎ ঘোষ মজুমদার যোগ্য সঙ্গত দিলেন। এঁদের বিপরীতে তিন মহিলা চরিত্রে কস্তুরী চক্রবর্তী, শ্রমণা চক্রবর্তী, শ্রীময়ী রায় যথাযথ। শ্যাম চরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এখানে সেই চাপ সামলে অনায়াস সাবলীলতায় ‘শ্যামদা’ পার্থ ভৌমিক। কমেডি, রোমান্স, শেষ দৃশ্যের আবেগ, একদম মাপা ঠিকঠাক অভিনয়। অনুরাধা চরিত্রে অপর্ণা সেনের ছায়া সামলে এখানে দেবযানী সিংহ। ওঁর একাধিক অভিনয় দেখা হল। মঞ্চে পাওয়ারফুল অভিনেত্রী, চরিত্রটাকে একদম নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন। বাকিরাও যথাযথ। তবে আলাদা করে বলব স্টেশনমাস্টারের ভূমিকায় অতনু মিত্রের কথা, চরিত্রটি মঞ্চে সংযোজন। পরিচালনায় দেবাশিস। সহকারী নির্দেশক ঋক দেব। প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন একটা নাটক, যার আসল সিনেমাটি চোখে ভাসে, সবটা অতি চেনা লাগে, অথচ সেই চেনার মধ্যেও এক নতুন ভালোলাগার আবিষ্কার, এটাই এই মঞ্চ সংস্করণের সার্থকতা।
শোয়ের পরে পার্থ ভৌমিকের ব্যাখ্যা, “বাংলা থিয়েটারের শ্যামবাজার ঘরানা আর শম্ভু মিত্রের ঘরানার মাঝখান দিয়ে, খানিকটা মিশ্রণে, সময়োপযোগী একটি তৃতীয় পথ নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি। থিয়েটারের বৈশিষ্ট্য ও গুণমান, সঙ্গে আজকের দর্শকের সুস্থ বিনোদন; সবটাই থাকছে মঞ্চ উপস্থাপনায়।”
আজকের বঙ্গ নাট্যমঞ্চে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে বহু সংগঠন, বহু শিল্পী যে চর্চা করে যাচ্ছেন, তার সামনের সারির প্রথম মুখ হিসাবে যদি ব্রাত্য স্বীকৃত হয়ে থাকেন, তা হলে এই ঘরানার মধ্যেই এক স্বতন্ত্র গবেষণায় জনপ্রিয় সিনেমাগুলিকে মঞ্চে আনার দুরূহ অ্যাডভেঞ্চারে শামিল পার্থ ভৌমিকরা। পুরনো নাটক নতুন করে নামানো হয়, নতুন নাটক তৈরি হয়, নাটকভিত্তিক সিনেমা নতুন নয়; কিন্তু কালজয়ী সিনেমাকে মঞ্চে নামানোর এই কঠিন অভিযানে আমি এক দর্শক হিসেবে ‘বসন্ত বিলাপ’কে দশে আট দিলাম।