পুরোদস্তুর ছাপোষা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ গৃহিনী। গল্পের প্রয়োজনে পোশাকে চাকচিক্যের লেশমাত্র নেই। ৩ সেপ্টেম্বর হইচই-এর প্ল্যাটফর্মে এভাবেই ধরা দেবেন স্বস্তিকা। সৌজন্যে পরিচালক সুদীপ্ত রায়ের ‘তাসের ঘর’। সেই সুবাদেই সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল-এর সঙ্গে কথা বললেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় (Swastika Mukherjee)। নতুন সিনেমা, লকডাউনের মনখারাপ, সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল, বডি শেমিং, সুশান্ত প্রসঙ্গ টেলিফোনিক আড্ডায় বাদ গেল না কোনও প্রসঙ্গই। শুনলেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
‘তাসের ঘর’ ছবিতে তোমার চরিত্রটা সম্পর্কে একটু শুনে নেব। পোস্টার দেখে মনে হল, আর ৫জন সাধারণ ঘরোয়া এক নারীর গল্প।
স্বস্তিকা- লকডাউনে প্রত্যেক গৃহিণীর যা অবস্থা হয়েছে, ‘তাসের ঘর’-এর সুজাতাও ঠিক সেরমই একটা গল্প বলবে। বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন দর্শকরা। সুজাতা এমন একটা চরিত্র যে সারাদিন রান্নাঘরে ডুবে থাকতেই ভালবাসে। গাছ পরিচর্যা করতে ভালবাসে। আবার একাকীত্বও ভালবাসে।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় কোথাও যে সংসারে ঘেরাটোপে পড়ে অনেক মহিলাই নিজের স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন..
স্বস্তিকা– সেটা তো কমবেশি সবারই হয়। যাঁদের কাছে সংসারটাই একমাত্র জগৎ, তাঁরাও প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে খুঁজে চলেছে। আর আমরা যাঁরা বাইরেই বেশি সময় কাটাই, সংসারে অত মন দিতে পারিনা, তাঁরাও কোথাও একটা নিজেকে খুঁজছি। তবে সেদিক থেকে সুজাতা অন্যরকম। সে বাইরের জগৎটাকে এক্সপ্লোর করার থেকে একান্ত নিজের জগৎটাকে এক্সপ্লোর করতে বেশি পছন্দ করে। নিজের সংসারের ভিতরেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চায় সুজাতা।
হিন্দি ওয়েব সিরিজ, বাংলায় ওয়েব প্ল্যাটফর্মের জন্য ছবি, কোথাও কি মনে হয় যে বড় পর্দার থেকে এখন ওয়েব প্ল্যাটফর্মটার গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে?
স্বস্তিকা-– প্যান্ডেমিক সিচুয়েশন যখন আসেনি, তখনও বহু মানুষদের বলতে শুনেছি যে, আরেকটু অপেক্ষা করি, আর হলে গিয়ে কী হবে! দাঁড়া না দুদিন বাদেই তো ওয়েব প্ল্যাটফর্মে চলে আসবে। সত্যিই তো সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার ১-২ মাসের মধ্যে সেগুলো ওয়েব প্ল্যাটফর্মে চলে আসছে। দর্শকরা এমনিই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছিল, এই অতিমারী পরিস্থিতি সেই চিন্তাভাবনাকেই আরেকটু উসকে দিল। এই অতিমারীতে দর্শকদের যে অভ্যেসটা হয়ে দাঁড়াল, ভ্যাকসিন বেরিয়ে গেলেও দর্শকরা আবার কতটা হলমুখো হবেন, তা সন্দেহের।
সবাই তো একটা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন এখন। তাই কেউ যদি টাকা দিয়ে ওয়েব চ্যানেলের রিচার্জ করেন, তিনি তো চাইবেনই সেখান থেকে বিনোদনের পুরো ফায়দাটা লুটতে।
দিন কয়েক আগেই ‘তাসের ঘর’-এর পোস্টার ঘিরে অশ্লীল, কদর্য মন্তব্য করা হয়েছিল আপনার উদ্দেশে। এই ‘সাইবার বুলিং’ বিষয়টা কি আজকাল কোথাও গিয়ে একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়?
স্বস্তিকা– ভেবেছিলাম, সারা বিশ্বজুড়ে এই অতিমারীতে হয়তো মানুষের মন-মানসিকতা একটু বদলাবে। কিন্তু কোথায় আর, সেই যে-কে সেই! পালটেছে। তবে উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। ওর বুক, ব্রায়ের স্ট্র্যাপ, তার জাঙিয়া, হাফপ্যান্ট.. এসব নিয়ে বলে চলেছে। আমার গা, আমার ব্রা, আমার স্ট্র্যাপ.. আমি সেটাকে বের করব, না সাজিয়ে রাখব, না কী করব! সেটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
আমি বুঝি না সমস্যা কোথায়! লোকের কি অজানা যে মহিলারা ব্রা পরে? সমাজ যদি না পরার অপশন দেয়, তাহলে আমরাই সবার আগে বেঁচে যাই। যুদ্ধে যাওয়ার আগে পুরুষ মানুষেরা যেরকম রণসজ্জায় সেজে যেত, সেরকমই তো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মহিলাদের জন্য। একটা অন্তর্বাস পরে ২৪ ঘণ্টা কাটানো বরং আনহেলথি। একটা সিগারেট খেলে চিন্তা বেড়ে যায় যে, ফুসফুসের ক্যানসার হবে! তো সারাক্ষণ টাইট ব্রা পরে স্তন ঢেকে রাখা থেকেও তো ব্রেস্ট ক্যানসার হতে পারে। কোথায় সেটা নিয়ে তো চিন্তা দেখি না! হঠাৎ একটা ছবির পোস্টার দেখে মানুষ এমন শুরু করল যেন, আমাকেই নারী হিসেবে প্রথম ব্রা পরতে দেখেছে!
[আরও পড়ুন: থামছে না সাহায্যের হাত! বৃদ্ধার আমফান বিধ্বস্ত বাড়ি মেরামতির দায়িত্ব নিলেন দেব]
অনেক মেয়েদেরই আকছার এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। তাদেরকে কী অ্যাডভাইস দেবেন? কারণ এই প্রজন্মের মেয়েদের অনেকেই আইকন হিসেবে দেখে আপনাকে।
স্বস্তিকা– লকডাউনে আমাদের জীবনযাত্রা অনেকটাই বদলেছে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে পারছি না, পার্টি করতে পারছি না! এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেগেটিভিটি থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততটাই মঙ্গল। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া। আমাদের কাছে যে উপায়টা নেই। আমরা যা কাজ করছি, সেটা রিলিজ হচ্ছে ডিজিটালি। প্রমোশনও হচ্ছে ডিজিটালি। কারণ, মানুষের কাছে কাজ তুলে ধরার এখন একমাত্র প্ল্যাটফর্ম সোশ্যাল মিডিয়া। তাই এটা থেকে পালানোর কোনওরকম রাস্তা নেই তারকাদের। কিন্তু যাদের সেই উপায় রয়েছে, তাঁদের বলব, একটু ফিল্টার করেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা ভাল। কারণ অনেকেই এতে ভীষণরকম অ্যাফেক্টেড হচ্ছে।
কারও হয়তো চেহারা জিরো সাইজ নয়। আমার মতো চেহারা। আমারও তো কুড়িটা সেলফি তুললে একটা পাতে দেওয়ার মতো হয়। আমার মতো এরকম অনেকেই রয়েছেন, যারা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল সম্পর্কে পারদর্শী নন। কেউ হয়তো একটা শাড়ি পরে নিজের ইচ্ছেমতো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন। তারপর দুশোজন লোক এসে তাঁকে তাঁর শরীর নিয়ে, পেছন নিয়ে, তাঁর বুক নিয়ে কদর্য কমেন্ট করে তাঁর আত্মবিশ্বাসটাকে ধ্বংস করে দিল। কেউ চাইলেই তাঁর নাচের কিংবা শিল্পের সমালোচনা করতে পারেন, তাতে কারও মনোক্ষুণ্ণ হবে না! “কিন্তু আপনি এরকম শরীর নিয়ে কেন নাচছেন? আপনার বুক ঝুলে গেছে, সেটা নিয়ে কেন নাচলেন? কেন এক্সারসাইজ করে মেদ কমাচ্ছেন না!…” এরকম হাজারও কদর্য মন্তব্য করা শুরু করা হয়। সবার তো আমার মতো মনের জোর না-ও থাকতে পারে। আমি তো ইচ্ছে করে আমার ডাবল-ট্রিপল চিন দেখিয়ে পোস্ট করি! আমি বিশ্বাস করি আমার যা আছে, তাতে আমি ভীষণ খুশি। এই মানসিকতা আরও দশজন মহিলার না-ও থাকতে পারে। তাই তাঁদের বলব, নেগেটিভি থেকে দূরে থাকতে একটু বেছে, ভেবেচিন্তে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করুন। আমার সেই অপশনটা নেই কাজের জন্য, কিন্তু আপনাদের তো রয়েছে।
এক সাক্ষাৎকারে আপনাকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, মুম্বইতে বাইরের ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের কাজ পেতে গেলে বেশ বেগ পেতে হয়। এটা কী সত্যি? কারণ আপনি তো ইতিমধ্যেই ২টো হিন্দি ছবি, ওয়েব সিরিজ করে ফেলেছেন।
স্বস্তিকা-– বাইরের ইন্ডাস্ট্রি বলতে যাঁরা বাংলা, অহমিয়া কিংবা উড়িয়া ছবিতে কাজ করেন, তাঁদের পক্ষে মুম্বইতে গিয়ে পা জমাতে একটু সময় লাগে। তুলনামূলকভাবে পূর্ব ভারতের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির থেকে পাঞ্জাবী কিংবা দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির দিকে বলিউড কিন্তু একটু বেশি ঝোঁকে। পাঞ্জাবী গানের একটা সাংঘাতিক প্রভাব রয়েছে বলিউড মিউজিকে। পাব কিংবা ডিস্কেও তো পাঞ্জাবী-বলিউড গানের একটা চল রয়েছে। দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির থেকে অনেকেই বলিউডে ভাল কাজ করছেন।
‘দিল বেচারা’য় কিজি বাসুর মায়ের ভূমিকায় কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন?
স্বস্তিকা– ‘পাতাললোক’ দেখে বিদ্যা বালান ফোন করেছিলেন। আমির খান নিজে মেসেজ করেছিলেন। এই সিরিজটা করে ‘ন্যাশনালি স্ট্রে-ডগ মাদার’-এর তকমা পেয়ে গিয়েছিলাম। আর ‘দিল বেচারা’ করে ‘ন্যাশনাল হিউম্যান মম’-এর আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আমি সত্যিই ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ‘দিল বেচারা’র পর থেকেই সারাক্ষণ মেসেজ আসছে যে, “আপনাকে এই প্রথম দেখলাম।” আমি ভাবি, এই কুড়িটা বছর ধরে জীবনে যে কী করছিলাম, কে জানে! (হেসে)
‘দিল বেচারা’র কাস্টিংয়ে গুগলে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের নাম নেই কেন? বাঙালি-অবাঙালি অনেককেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করতে দেখেছি।
স্বস্তিকা– ভাল লেগেছে বিষয়টা। এই প্রথম বোধহয় জীবনে কোনও কিছুর জন্য আমাকে নিজেকে প্রতিবাদ করতে হয়নি। বরং, আমার হয়ে অন্যেরা প্রতিবাদ করেছে।
এই মুহূর্তে হাতে আর কোনও হিন্দি প্রজেক্ট বা বাংলা ছবি রয়েছে?
স্বস্তিকা– বিরসা দাশগুপ্তর পরিচালনায় জিফাইভের জন্য একটা হিন্দি ওয়েব সিরিজ করছি। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় তার শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। আরও কিছু হিন্দি ওয়েব সিরিজের কাজ রয়েছে হাতে।
তাহলে কি আগামী কয়েক মাস মুম্বইয়ের বাসিন্দা হচ্ছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়?
– মোটামুটি জানুয়ারি অবধি তাই মনে হচ্ছে! (হেসে)
সিবিআইয়ের হাতে যে সুশান্তের মামলা গেল, সেটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কী মত?
স্বস্তিকা– আমরা যারা ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা তো বটেই, এমনকী গোটা দেশের আমজনতা লড়েছে সুশান্তের জন্য। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই আমি চেয়েছিলাম ওঁর পরিবারের তরফে যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, আমি সেটাকে সম্মান করব। কারণ, আমরা যতই হ্যাশট্যাগ ক্রিয়েট করি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ করি, আদালতের কাছে সেসব ধোপে টিকবে না! এখন কেসটা ওঁর পরিবারের সায়ে সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে, আমিও তাতে একমত এবং খুশি। বিচার নিশ্চয় পাবেন সুশান্ত।
এই লকডাউনে কীভাবে দিন কাটছে? প্যান্ডেমিক সিচুয়েশনে মন ভাল করার টিপস কী দেবেন?
স্বস্তিকা– সবার মতো আমাকেও বাড়ির সব কাজ করতে হচ্ছে। জুলাই অবধি মুম্বইতে ছিলাম। সেখানে তো রান্না থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজ করতে হয়েছে। আর ভাল থাকাটা মানুষ বিশেষে নির্ভর করে। যার যেটা করতে ভাল লাগে, তিনি মন ভাল রাখার জন্য সেটাই করুন। তবে হ্যাঁ, এই গৃহবন্দি জীবনে নেগেটিভিটি থেকে দূরে থাকুন।
[আরও পড়ুন: ‘NEET-JEE নিয়ে মোদি সরকারের সিদ্ধান্তে আপনি চুপ কেন?’, ধনকড়কে খোঁচা নুসরতের]
The post ‘আমার ব্রায়ের স্ট্র্যাপ বের করব, না সাজিয়ে রাখব, একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার’, ফের অকপট স্বস্তিকা appeared first on Sangbad Pratidin.