shono
Advertisement

অণুজীবেই জব্দ জীবাণু, জেনে নিন পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মাছ ও চিংড়ি চাষের উপায়

অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ক্ষতিকর জীবাণুর মধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়ছে।
Posted: 09:25 PM Jun 29, 2022Updated: 09:25 PM Jun 29, 2022

মাছ ও চিংড়ির রোগজীবাণু দমনে নানাবিধ অ‌্যান্টিবায়োটিকের (জীবাণুনাশক) যথেচ্ছ ব‌্যবহার এ শিল্পকে ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ধারাবাহিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মাছ চাষের জন‌্য পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও বিদ‌্যমান রোগের ঝুঁকি কমাতে উপকারী অণুজীব বা প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার একটি উদীয়মান প্রযুক্তি। লিখেছেন রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের শস্য শ‍্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ (মৎস্য চাষ) ড. স্বাগত ঘোষ। পড়ুন প্রথম পর্ব।

Advertisement

আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মাছ ও চিংড়ি অন‌্যতম রফতানি পণ‌্য হিসাবে স্বীকৃত। দেশের অভ‌্যন্তরীণ বাজারেও চিংড়ির ব‌্যাপক চাহিদা রয়েছে। গুণগতমান ও আকারভেদে দেশেই প্রতি কেজি চিংড়ি ৬০০-১২০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় এই শিল্প আজ নানা কারণে ঝুঁকির মুখে। বিগত কয়েক বছর ধরে বাগদা চিংড়ির ক্ষেত্রে চাষ পর্যায়ে ও গলদা চিংড়ির ক্ষেত্রে হ‌্যাচারি পর্যায়ে চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ায় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রফতানি পণ‌্যটি এখন ব‌্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। চিংড়ির রোগজীবাণু দমনে নানাবিধ অ‌্যান্টিবায়োটিকের (জীবাণুনাশক) যথেচ্ছ ব‌্যবহার এ শিল্পকে ক্রমশ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত অ‌্যান্টিবায়োটিকের ব‌্যবহারের ফলে ক্ষতিকর জীবাণুসমূহের মধ্যে প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তেমন কোনও টেকসই প্রতিরোধ ব‌্যবস্থা গড়ে তোলা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে বেশ কিছু ধারাবাহিক গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে মাছ চাষের জন‌্য পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও বিদ‌্যমান রোগের ঝুঁকি কমাতে উপকারী অণুজীব বা প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার একটি উদীয়মান প্রযুক্তি। তাই প্রথমেই প্রোবায়োটিকের পরিচিতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও পরে মাছ ও চিংড়ি চাষে প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার বিষয়ে আলোকপাত করা হল।
প্রোবায়োটিক বা উপকারী অণুজীব বলতে কী বোঝায়?
জীবিত অণুজীব পোষকের (মাছ, চিংড়ি, মানুষ ইত‌্যাদি যে কোনও প্রাণী) দেশে ও পরিবেশে উপস্থিত থেকে পোষককে ক্ষতিকর রোগজীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয় ও পোষকের দৈহিক বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ‌্য নিশ্চিত করে সেসব উপকারী অণুজীবকেই প্রোবায়োটিক নামে অভিহিত করা হয়। সহজ কথায়, প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারী বা বন্ধু অণুজীব ( প্রধানত ব‌্যাকটিরিয়া জাতীয়) যাদের উপস্থিতিতে ক্ষতিকর অণুজীব দমন করা যায় এবং এদের ক্ষতি করার ক্ষমতাও কমানো যায়। ফলে চাষযোগ‌্য প্রজাতিকে বিভিন্ন রোগব‌্যাধির হাত থেকে বঁাচিয়ে পরিবেশ বান্ধব চাষ ব‌্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন এবং সার্বিক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়। কেবল মাছে বা চিংড়িতে নয়, বরং গৃহপালিত প্রাণী এমনকী মানুষকেও নির্ধারিত প্রোবায়োটিক খাওয়ানো হলে তার পেটের স্বাস্থ‌্য ঠিক থাকে, পেটের ভিতরের ক্ষতিকর অণুজীবের সংখ‌্যা কমে যায়, উপকারী অণুজীবের সংখ‌্যা বেড়ে যায় এবং ক্ষতিকর অণুজীবের ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেকাংশে কমে যায়, ফলে সুস্বাস্থ‌্য নিশ্চিত করা যায়।

[আরও পড়ুন: বাড়িতে কৃত্রিম মরুভূমি বানিয়ে দুম্বা চাষ, আয়ের নতুন দিশা দেখালেন মালদহের মিরাজুল]

প্রোবায়োটিকের উপকারিতা
প্রোবায়োটিক জীবদেহে ও পরিবেশে উপস্থিত থেকে প্রত‌্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেমন –

১) চাষকৃত প্রজাতির অন্ত্রে উপকারী অণুজীবের বংশবিস্তার করে।
২) ক্ষতিকর জীবাণুর টিকে থাকাও সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
৩) ক্ষতিকর জীবাণুরোধী বস্তু (ব‌্যাকটিরিওসিন ও জৈব অ‌্যাসিড) নিঃসৃত করে ও বিপাকীয় উৎসেচক (Digestive Enzymes) উৎপন্ন করে।
৪) হজমে সহায়তা করে।
৫) বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভিটামিন উৎপাদনে সহায়তা করে।
৬) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৭) ক্ষতিকর জীবাণুর অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধে জৈবিক নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে কাজ করে।
৮) পোষকদেহের পীড়নজনিত ক্ষতিকর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে সুস্বাস্থ‌্য নিশ্চিত করে।
৯) পরিবেশের মাটি ও জলের উন্নয়ন ঘটায়, কতিপয় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান নিষ্ক্রিয় করে ইত‌্যাদি। তাই মাছ ও চিংড়ি চাষে প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার প্রয়োজন।
প্রোবায়োটিকের কার্যকারিতা
জীবদেহে প্রোবায়োটিক ঠিক কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে বিগত কয়েক দশকের গবেষকগণ তাঁদের গবেষণার ভিত্তিতে নানা তথ‌্য দিয়েছেন। প্রোবায়েটিকের কাজের ক্ষেত্রে বর্ণিত উপায় ও পদ্ধতিগুলি খুব সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হল।
• অন্ত্রের অভ‌্যন্তরে উপকারী অণুজীব বংশবিস্তার করে অন্ত্রে ফলে ক্ষতিকর জীবাণু অন্ত্রে বংশবিস্তারের সুযোগ পায় না ও নিষ্ক্রিয় হতে বাধ‌্য হয়। একে ক্ষতিকর জীবাণুসমূহের বাসস্থানগত প্রতিযোগিতামূলক দমন বা দূরীকরণ (Competitive exclusion of pathogenic bacteria) পদ্ধতি বলে।
• পর্যাপ্ত সংখ‌্যক উপকারী অণুজীব জীবদেহ ও পরিবেশে থাকলে তারা স্বভাবতই প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানসমূহ প্রাপ্তির প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী হয়ে থাকে। পুষ্টি উপাদানসমূহ প্রাপ্তিতে এই প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে ক্ষতিকর অণুজীবের বৃদ্ধি ব‌্যাহত হয় ও তারা টিকে থাকতে পারে না। কিছু কিছু প্রোবায়োটিক উদ্বায়ী ফ‌্যাটি অ‌্যাসিড ও ক্ষতিকর জীবাণুরোধী বস্তু (Antibacterial compounds) তৈরি করায় ক্ষতিকর অণুজীবের বৃদ্ধি ব‌্যাহত হয় ও তারা দূরীভূত হয়।
• কিছু অণুজীব বিপাকীয় উৎসেচক (যেমন– প্রোটিয়েজ, লাইপেজ, অ‌্যালাইলেজ ইত‌্যাদি) নিঃসরণ ঘটিয়ে পোষকের বিপাক প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। বিপাকের মাধ‌্যমে উৎপাদিত দরকারি অ‌্যামাইনো অ‌্যাসিড, ফ‌্যাটি অ‌্যাসিড, ভিটামিন ইত‌্যাদি জৈব পুষ্টি উপাদান পোষক কর্তৃক সরাসরি পরিশোধিত হওয়ায় পোষকের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়।
• মাটি ও জলের গুণগত মান উন্নয়ন, পি-এইচ নিয়ন্ত্রণ, তলার বর্জ‌্য শোধ, ক্ষতিকর অ‌্যামোনিয়া ও নাইট্রাইট দূর করা ইত‌্যাদির জন‌্য প্রোবায়োটিক হিসাবে ব‌্যাসিলাস (Bacillus sp.) জাতীয় ব‌্যাকটিরিয়ার ব‌্যবহার বেশ প্রচলিত। এর ফলে মাছ বা চিংড়ি জাতীয় পোষকের দৈহিক বৃদ্ধি, বাঁচার হার ও সুস্বাস্থ‌্য নিশ্চিত হয়।
• কিছু কিছু ফোটোট্রপিক ব‌্যাকটিরিয়া সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে দ্রুত প্রাকৃতিক খাদ‌্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। আবার কিছু কিছু ব‌্যাকটিরিয়ার শৈবালনাশক প্রভাবকে (Algicidal Effect) কাজে লাগিয়ে অত‌্যধিক মাত্রার অবাঞ্ছিত শৈবাল (বিশেষত লাল শৈবাল স্তর) নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
• আবার কিছু কিছু প্রোবায়োটিক খাদে‌্যর সঙ্গে জীবদেহে প্রবেশ করালে তা রোগ প্রতিরোধ ব‌্যবস্থাকে (Immune system) উদ্দীপ্ত করে, প্রতিরক্ষামূলক শ্বেত রক্ত কণিকার (Leucocytes) ফ‌্যাগোসাইটিক ক্রিয়া বাড়িয়ে দেয়, ফলে জীবাণুনাশক ও রোগব‌্যাধি প্রতিরোধ সহজ হয়।
• এছাড়াও ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রোবায়োটিকের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা এখনও চলছে।

[আরও পড়ুন: নারকেল বাগানে গোলমরিচ চাষে প্রচুর আয়ের সুযোগ, জেনে নিন পরিচর্যার পদ্ধতি]

প্রোবায়োটিকের প্রয়োগ পদ্ধতি
কথায় বলে ‘রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম’ মাছ ও চিংড়ির অন্ত্রে উপকারী ও অপকারী উভয় প্রকার অণুজীব থাকে। সুযোগসন্ধানী ক্ষতিকর অপকারী অণুজীবগুলি সুযোগ পেলেই মাছ ও চিংড়ির শরীরে রোগ সৃষ্টি করে, ফলে দৈহিক বৃদ্ধি ব‌্যাহত হয়, এমনকী মৃতু‌্যর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অপরদিকে প্রোবায়োটিক জীবেদেহের বিভিন্ন জৈবিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মাছ ও চিংড়ির অন্ত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ উপকারী অণুজীব বা প্রোবায়োটিকের সংখ‌্যা বজায় রাখাই জরুরি। কিন্তু অনেক সময় নানা কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক কারণে যেমন অ‌্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ বা এর বাহি‌্যক ব‌্যবহার, নানাবিধ পীড়ন ও ধকল, বাসস্থান ও খাদ‌্যাভ‌্যাসের পরিবর্তন ইত‌্যাদির কারণে উপকারী অণুজীবের সংখ‌্যা কমে যেতে পারে। পরিবেশে উপকারী এবং অপকারী অণুজীবের ভারসাম‌্যহীনতা দেখা দিলেই পরিবেশ দূষিত হয়, উপকারী অণুজীব বৃদ্ধির এবং অপকারী অণুজীবের ভারসাম‌্যহীনতা দেখা দিলেই পরিবেশ দূষিত হয়, উপকারী অণুজীব বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হয়, চাষযোগ‌্য প্রজাতিতে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় এবং ক্রমশ আরও নানা সমস‌্যা তৈরি হতে থাকে। তাই কেবল দূষিত পরিবেশে বা রোগাক্রান্ত অবস্থার জন‌্য নয় বরং সুস্থ ও স্বাভাবিক সময়কালেও মাছ ও চিংড়ি চাষে নিয়মিত প্রোবায়োটিক ব‌্যবহার করা উচিত।
প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার
জলজ পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন প্রকার উপকারী ও অপকারী অণুজীবের বংশবিস্তারের জন‌্য উপযুক্ত। এই পরিবেশে অপকারী অণুজীবগুলির আক্রমণে মাছ ও চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব রোগ সৃষ্টিকারী অপকারী অণুজীব নিয়ন্ত্রণে অ‌্যান্টিবায়োটিকের ব‌্যবহার হয়। কিন্তু অ‌্যান্টিবায়োটিকের মাধ‌্যমে ক্ষতিকর জীবাণু মেরে ফেলা গেলেও একইসঙ্গে জীবদেহে ও খামারের আশপাশের পরিবেশে বিদ‌্যমান নানান উপকারী অণুজীবেরও ব‌্যাপক ক্ষতি হয়। অ‌্যান্টিবায়োটিক অপরিমিত ও অবাধ প্রয়োগের ফলে ক্ষতিকর জীবাণুর নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা (Resistance power) তৈরি হয়। ফলে একসময় অ‌্যান্টিবায়োটিকের মাধ‌্যমে ক্ষতিকর জীবাণু আর দমন করা যায় না। তা ছাড়া অ‌্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মানবদেহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এজন‌্যই রোগ দমনে অ‌্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসাবে প্রোবায়োটিকের ব‌্যবহার অধিক যৌক্তিক এবং স্থায়িত্বশীল বলে বিবেচিত হচ্ছে।

[আরও পড়ুন: পুরনো চাল ভাতে বাড়ে! নোনা মাটিতে হারিয়ে যাওয়া ধানের ফলন বাড়াতে জোর কৃষিদপ্তরের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement