shono
Advertisement

কীভাবে মাছির হাত থেকে বাঁচাবেন ফল? উপায় জানালেন বিশেষজ্ঞ

জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের মত।
Posted: 06:34 PM Aug 08, 2021Updated: 08:42 PM Aug 08, 2021

সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০০ প্রজাতি এবং ভারতবর্ষে প্রায় ২৪০ প্রজাতির ফলের মাছি পাওয়া যায়। এই পতঙ্গের আক্রমণের ফলে উদ‌্যান ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিপুল ক্ষতি হয়। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, এই ক্ষতির বার্ষিক অর্থমূল‌্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। ফসল বাঁচাতে এই মাছি নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে লিখলেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ‌্যাপক শান্তনু ঝা।

Advertisement

মাছি শীত বা গ্রীষ্মপ্রধান প্রায় সব এলাকায় বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি করে মাছি। এরা সাধারণত বিভিন্ন প্রকার ফল (যেমন জাম, পেয়ারা, বাতাবি, কমলালেবু, জামরুল, কুল ইত‌্যাদি) ও লতা জাতীয় সবজিতে যেমন পটল, ঝিঙে, উচ্ছে, মিষ্টি কুমড়ো ইত‌্যাদিতে আক্রমণ করে। এমনকী বাঁশের চারা বেরনোর সময়, একেবারে কচি অবস্থায় মাছি আক্রমণ করে। এখন পর্যন্ত এদের প্রায় ৪০০০ প্রজাতি গোটা পৃথিবীতে পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষে প্রায় ২৪০ প্রজাতির ফলের মাছি পাওয়া যায়। এই পতঙ্গের আক্রমণের ফলে উদ‌্যান ফসলের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিপুল ক্ষতি হয়। হিসেব করে দেখা গিয়েছে, এই ক্ষতির বার্ষিক অর্থমূল‌্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

ফলের ক্ষতিকারক পদ্ধতি

সাধারণভাবে পোকা কেটে বা কুরে খেয়ে ফেলে অথবা রস খেয়ে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি সাধন করে। সাদা মাছির মতো পোকা আবার বিভিন্ন ফসলে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটিয়ে ফসল নষ্ট করে। কিন্তু স্ত্রী মাছি মূলত ফলের খোসার নিচে ডিম পেড়ে ফসলের ক্ষতি করে। স্ত্রী মাছি তার লম্বা ডিম্ব স্থাপন নিয়ে ফল ও সবজির খোসায় ছিদ্র করে। তার নিচে ডিম পাড়ে। সেই ছিদ্র দিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন প্রকার জীবাণুও প্রবেশ করে। ফলে পচন ধরাতে শুরু করে। ডিম ফুটে যে কিড়া বের হয়, তারা শুধু ফলের পচে যাওয়া মাংসল অংশ থেকে বড় হতে থাকে। আক্রান্ত ফল বা সবজি তাড়াতাড়ি পচে যায় এবং বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।

সমস্যা ও গুরুত্ব

ফলের মাছির উপদ্রব বাড়ে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে। যে ফলের মাছিগুলির উপদ্রব মূলত পশ্চিমবাংলায় দেখা যায় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্টোসেরা ডরসালিস। এই পোকার আক্রমণে আম ও গ্রীষ্মের পেয়ারা, বাতাবি লেবু, জামরুল ইত‌্যাদির প্রায় ৩০০ ধানের ফলের বিপুল ক্ষতি করে। আমের বিভিন্ন জাতের মধ্যে আম্রপালি, রাখালভোগ, ফজলি, হিমসাগরে এর আক্রমণ বেশি হয়। যাঁরা গাছপাকা আম ভাঙতে চান, তাঁদের বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। মরশুমের শুরুর দিকের যে আমগুলি পাকে সেগুলোতে এই পোকার আক্রমণ কম হয়। ল‌্যাংড়া, লক্ষ্মণভোগ, বোম্বাই ইত‌্যাদি জাতের আমে এর আক্রমণ কম হয়। গ্রীষ্মের পেয়ারায় এই পোকার আক্রমণে এমনকী ১০০% পর্যন্ত ফল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। গুরুত্বের দিক দিয়ে এরপরে আসে লতা সবজির মাছি। তথ‌্য সংগ্রহ করে দেখা গিয়েছে এই প্রজাতির মাছি কিউবারবিটি গোত্রের প্রায় সমস্ত ফসলেই আক্রমণ করে। এর আক্রমণে ৫০-৬০% পর্যন্ত উচ্ছে, ২০-২৫% পর্যন্ত শসা, ১৭% পটল, প্রায় ৫০% পর্যন্ত ঝিঙে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দার্জিলিং, কালিম্পঙে কমলালেবু চাষেও ব্যাক্টোসেরা মিনাঙ্ক গোত্রীয় মাছি বিপুল ক্ষতি করে। ৫০% পর্যন্ত কমলালেবু প্রতি বছর এই পোকার আক্রমণের ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই পোকার আক্রমণের কারণে ভারতবর্ষ থেকে বিভিন্ন ফল, সবজি বিদেশের বাজারে পাঠানো খুব কঠিন হয়ে যায়। শুধু কীটনাশক ব‌্যবহার করে এই পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সে সমস্ত প্রয়োগ করা কীটনাশকের অবশেষ ফল বা সবজিতে থেকে যাওয়ার ফলে বিপদ আরও বাড়ে।

জীবনচক্র

স্ত্রী মাছি ফল বা সবজির খোসার নিচে ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে দুই-এক দিনের মধ্যেই সাদা রঙের কিড়া জন্ম নেয়। চর্ম নির্মোচনের মাধ‌্যমে তারা ধীরে ধীরে আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অবশেষে হলুদ রঙের স্থুলকায় কিড়াতে পরিণত হয়। পরিণত কিড়া ফল থেকে বেরিয়ে এসে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে। মাটির নিচেই তারা মূককীট দশা অতিবাহিত হয়। বাদামি শক্ত আবরণে ঢাকা এই মূককীটগুলি প‌্যারেলের মতো চেহারা নেয়। এই অবস্থায় তারা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত থাকে। এরপর পরিণত মাছি মূককীটের আবরণ কেটে বেরিয়ে আসে। সদ্যোজাত স্ত্রী মাছি প্রায় দেড় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম দিতে পারে না। স্ত্রী মাছির পরিণত হওয়ার জন‌্য প্রোটিন খাদ‌্য প্রয়োজন হয়। সাধারণভাবে বিভিন্ন ফুলের পরাগরেণু এই প্রোটিনের উৎস হিসাবে কাজ করে।

[আরও পড়ুন: উন্নতমানের ধান উৎপাদনে Genetics-এর প্রয়োগ, আমেরিকাকে পথ দেখাবেন বর্ধমানের তরুণ]

নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি

এ জাতীয় ফলের মাছির চরিত্রগত বৈশিষ্ট‌্য হল, পূর্ণাঙ্গ মাছি যে গাছের ফলে ডিম পাড়ে, সেগাছে তারা অন‌্য সময় অতিবাহিত করা বা বিশ্রাম গ্রহণ করে না। ফলে গাছে প্রক্রিয়ামূলক কীটনাশক স্প্রে করে এর পূর্ণাঙ্গ পোকাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আবার কোনও বিশেষ একটি জমিতে নিয়ন্ত্রণ ব‌্যবস্থা গ্রহণ করলেও দূরবর্তী অন‌্য জমি থেকে মাছি উড়ে এসে ডিম পাড়তে পারে। ফলে ফলের মাছি নিয়ন্ত্রণে এলাকা জুড়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা অত‌্যন্ত জরুরি।

যে পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা প্রয়োজন

১. আক্রান্ত ফল বা সবজি মাটিতে পড়ে থাকতে দেওয়া যাবে না। আক্রান্ত ফল দ্রুত সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা জলে ডুবিয়ে রেখে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
২. শীতে জমিতে চাষ দিলে, মাটির তলায় থাকা পিউপাগুলি নষ্ট হয়ে যায়। কমলালেবুর ক্ষেত্রে মার্চ মাস নাগাদ গাছের তলার মাটি কুপিয়ে একটি সোচ দিলে পিউপাগুলি নষ্ট হয়ে যায়।
৩. আম বা অন‌্যান‌্য ফলের গাছের কাণ্ড থেকে ডালপালা বেরনোর সংযোগস্থলে ঘোলা গুড়ের সঙ্গে স্পিনোস‌্যাডের মতো কোনও কীটনাশক মিশিয়ে ব্রাশ দিয়ে লাগিয়ে দিতে হবে। পূর্ণাঙ্গ মাছি আকৃষ্ট হয়ে কীটনাশকের সংস্পর্শে এসে মারা পড়বে।
৪. কিছু কিছু ফল (যেমন আম) খুব পরিপক্ক হয়ে ওঠার আগেই পেড়ে ফেললে মাছির আক্রমণ থেকে অনেকটা রক্ষা করা যায়।
৫. একর প্রতি ৮টি মিথাইল ইউজিনল (আম, পেয়ারার ক্ষেত্রে) অথবা কিউলিওর (লতানো সবজির ক্ষেত্রে) ফাঁদ লাগিয়ে পুরুষ মাছিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর ফলে অনিষিক্ত স্ত্রী মাছি ডিম পাড়তে পারে না। শুধুমাত্র কমলালেবুতে আক্রমণকারী মাছির কোনও ফাঁদ পাওয়া যায় না। মার্চ মাসে গাছের তলায় মাটি কুপিয়ে একটি সেচ দেওয়া ছাড়া ফল পাকার আগেই, বৃষ্টি একটু কমলে গাছের গোড়ায় পলিমালচিং করলে ফল পড়লেও মাটির সংস্পর্শে আসতে পারে না। ফলে পিউপেশন হতে পারে না।
৬. এই মাছির আক্রমণ প্রবণ এলাকা থেকে ফল বা সবজি ভেপার হিট ট্রিটমেন্ট করেই বিদেশে রপ্তানি করা যায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement