shono
Advertisement

এবার রঙিন অর্কিড দেখাবে আয়ের দিশা, জেনে নিন এই ফুল চাষের অ আ ক খ

এখন প্রায় সারা বছর ধরেই অর্কিড ফুল উৎপাদন সম্ভব।
Posted: 09:41 PM Sep 08, 2022Updated: 09:43 PM Sep 08, 2022

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফুলের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এটা এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য পণ্য যার মূল্য হাজার হাজার কোটি ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল উৎপাদিত হয়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফুলের উৎপাদন ও বিপণন ক্রমে ক্রমে শিল্পপণ্য উৎপাদনসম বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে। যাকে এখন ‘পুষ্পশিল্প’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ফুলের রাজ্যে অর্কিড এক অনিন্দ্যসুন্দর ফুল। এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। আকর্ষণীয় রং, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, ফুলদানিতে দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল ও সুগন্ধ এসব মিলে অর্কিডকে দিয়েছে এক সম্ভ্রান্ত রূপ। যে কারণে পৃথিবীর সব জায়গাতেই এর সমাদর। লিখেছেন স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তন্ময় সরকার।

Advertisement

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তর প্রজাতির অর্কিড জন্মাতে দেখা যায়। যে কারণে এর আদি বাসস্থানও এক জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই। হিমালয়ের পূর্বাংশে খাসিয়া পাহাড়, থাইল্যান্ড, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, মেক্সিকো, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার উষ্ণ অঞ্চলে অর্কিড পাওয়া যায়। এই ফুল অর্কিডেসি পরিবারের সদস্য। তথ্যমতে, বিশ্বে অর্কিডের ৩০ হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। আকর্ষণীয় রঙ, বিভিন্ন ধরনের গড়ন, ঔষধি গুণাগুণ, সুগন্ধি, দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল এসব বৈশিষ্টের কারণে অর্কিড উদ্ভিদের জনপ্রিয়তা এখন বাড়ছে। ফুলদানিতে দীর্ঘকাল সজীব থাকে বলে কাট ফ্লাওয়ার হিসাবে এর ব্যবহার সর্বাধিক। এ ছাড়া ছোট অবস্থায় এর গাছও শোভা বৃদ্ধি করে।

অর্কিডের শ্রেণিবিন্যাস ও জাত:
চাষ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অর্কিডকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল পার্থিব বা Terrestrial এবং পরাশ্রয়ী বা Epiphytic অর্কিড। যে সকল অর্কিড অন্যান্য ফুলের মত মাটিতে জন্মায় এবং সেখান থেকে খাদ্য ও রস সংগ্রহ করে তাদেরকে পার্থিব অর্কিড বলে। যেমন- অরুন্দিনা, ক্যালান্থে ইত্যাদি। অন্যদিকে, যে সমস্ত অর্কিড অন্য কোনও গাছের শাখা বা কাণ্ডের উপর আশ্রিত হয়ে জন্মে তাদেরকে পরাশ্রয়ী অর্কিড বলে। এ ধরণের অর্কিড থেকে অস্থানিক শিকড় বের হয়। এই শিকড়ের কিছু ব্যবহৃত হয় আশ্রয়দাতা গাছকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। আর বাকিগুলো বাতাসে ঝুলতে থাকে। যা কিনা বাতাস থেকে খাদ্য এবং জলীয় বাষ্প গ্রহণ করে গাছের পুষ্টি সাধনে সাহায্য করে। ডেন্ড্রোবিয়াম, ক্যাটলিয়া ইত্যাদি হল এ ধরণের অর্কিড। সুতোর মত সরু গুচ্ছমূল দেখে পার্থিব এবং লম্বা, মোটা ও পুরু মূল দেখে পরাশ্রয়ী অর্কিড চেনা যায়।

[আরও পড়ুন: একশো দিনের কাজে এবার ২০০ বিঘা জমিতে করলা চাষ, লাভের আশায় চাষিরা ]

অর্কিডেসি পরিবারের বেশ কতগুলো গণের জেনাস অধীনে অর্কিড বিন্যস্ত। বেশিরভাগ অর্কিড যে সব গণের অধীন তারা হল, ডেন্ড্রোবিয়াম (Dendronium, রেনানথেরা (Renenthera), সিলোগাইন (Celogyne), এপিডেন্ড্রাম (Epidendrum), ভ্যান্ডা (Vanda), ফেলনোপসিস (Phalaaenopsis), এরিডিস (Aerides), সিমবিডিয়াম (Cymbidium), ক্যাটলিয়া (Cattleya) ইত্যাদি।

জলবায়ু ও মাটি:
সকল অর্কিড চাষের জন্য এর স্বাভাবিক বাসস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। এর জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও ছায়ার প্রয়োজন। সাধারণত উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া অর্কিড চাষের জন্য উত্তম। প্রজাতিভেদে ১০-৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় অর্কিড ভাল জন্মে। আধো আলোছায়া এরূপ স্থান এই ফুল চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। পলিহাউসে অর্কিডের চাষ অধিক পরিমাণে করা হচ্ছে। ঠাণ্ডা ও শুষ্ক আবহাওয়ায় অর্কিডের বিভিন্ন প্রজাতি সফলভাবে চাষ করা হয়ে থাকে। পার্থিব অর্কিডের জন্য দোঁয়াশ মাটি ব্যবহার করা উত্তম। এ ছাড়া উপযুক্ত বায়ু চলাচল এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। পরাশ্রয়ী অর্কিডের জন্য সাধারণত নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বল তৈরি করে তার উপর লাগানো হয়ে থাকে। এই সমস্ত অর্কিড মাটি ছাড়াই ভালভাবে বাড়তে পারে।

বংশবিস্তার:
যৌন এবং অযৌন উভয় পদ্ধতিতেই অর্কিডের বংশবিস্তার করা যেতে পারে। যৌন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার কষ্টসাধ্য বলে অযৌন উপায়েই সচরাচর এর বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া টিস্যু কালচারের মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে সিমবিডিয়াম, ফেলেনপসিস ও ক্যাটলেয়ার অসংখ্য চারা উৎপাদন করা যায়। অফসেট, দাবাকলম এবং কাটিং-এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। ডেন্ড্রোবিয়াম এবং এপিডেন্দ্রাম শ্রেণীর অর্কিড থেকে অফসেট আলাদা করে ছোট পটে লাগিয়ে চারা তৈরি করা যায়। ভ্যান্ডা শ্রেণীর অর্কিড দাবা কলমের সাহায্যে চারা তৈরি করা যায়। ক্ষেত্রে কাণ্ডের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করে তা নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বেঁধে দিলে এতে শিকড় গজায়। এরপর কলম কেটে এনে ছোট টবে লাগাতে হয়। কাটিং-এর মাধ্যমে রেনেনথেরা এবং ভ্যান্ডা উভয়েই বংশবিস্তার করা যায়। যেহেতু এই শ্রেণির গাছে অস্থানিক মূল গজায় তাই এর কাণ্ড কয়েক টুকরো করে ঠাণ্ডা এবং শুকনো জায়গায় ভেজা বালি অথবা ভেজা নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে স্থাপন করতে হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন গাছের বৃদ্ধি নতুন শুরু হয় তখনই কলম করার উপযুক্ত সময়।

চাষ পদ্ধতি
পার্থিব বা টেরেস্ট্রিয়াল অর্কিড টব, গামলা অথবা ঝুলন্ত বাস্কেটে চাষ করা যেতে পারে। প্রথমে এগুলোর যে কোনও একটির ভিতরের তলদেশে কয়লা, খোয়া অথবা ঝামার টুকরো স্থাপন করতে হয় এবং এর উপরে নারিকেলের ছোবড়ার টুকরো অথবা আমগাছের বাকল ছড়িয়ে দিতে হয়। সবার উপরে পাতাপচা সার ও হাড়ের গুঁড়ো মিশ্রিত দোঁয়াশ মাটি দিয়ে টব ভর্তি করে তার উপর অর্কিডের চারা এমন ভাবে স্থাপন করতে হয় যেন এর শিকড়গুলো ছড়িয়ে থাকে। এরপর প্রয়োজনমত জল দিতে হবে। অতিরিক্ত জল প্রয়োগ করা উচিত নয়।

পরাশ্রয়ী অর্কিড কাঠ অথবা বিশেষ ধরনের টবে (যা অগভীর ও পোড়া মাটির হয় এবং নীচে ও পাশে বড় বড় ছিদ্র থাকে) অথবা বাঁশের ঝুড়িতে চাষ করা যায়। কাঠের উপর জন্মানোর ক্ষেত্রে আম অথবা জারুলের একখণ্ড কাঠের টুকরোর উপর তামার তার দিয়ে অর্কিডের চারাকে বেঁধে দিতে হয়। বাঁধবার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এর শিকড়গুলো চারিদিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে থাকে। মোটা ও পুরু শিকড়ের ক্ষেত্রে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ঢাকার দরকার হয় না। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সরু শিকড়ের ক্ষেত্রে এগুলিকে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। কিছু দিনের মধ্যে অর্কিডের নতুন শিকড় বের হয়ে কাঠের টুকরোকে জড়িয়ে ধরে।ঝুলানো টব হিসেবে পূর্বে বর্ণিত পোড়ামাটির টব অথবা বাঁশের বা কাঠের ঝুড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। বড় বড় গাছে যে ফার্ন হয় তার শিকড়, গাছের বাকল, নারকেলের ছোবড়া, কাঠ ও বাঁশের চিপস টুকরা টুকরা করে কেটে তার সঙ্গে কিছু কাঠ কয়লার টুকরো এবং ১০ গ্রাম পরিমাণ হাড়ের গুঁড়ো মেশাতে হয়। টব অথবা ঝুরির তলদেশে এক তৃতীয়াংশ ঝামা ইটের খোয়া দিয়ে ভর্তি করে তার উপর অর্কিডের চারা স্থাপন করে এর শিকড়গুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। একটি কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এই মিশ্রণ ঝামা ইটের খোয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে শক্ত করে দিতে হবে। অর্কিডের চারদিকে বাতাস সবসময় আর্দ্র রাখতে হয়। সেই লক্ষ্যে অর্কিডে ঘন ঘন সেচ দেওয়া উচিত। উষ্ণ এবং শুষ্ক মৌসুমে মার্চ-মে মাসে জলের প্রয়োজন বেশি। জলের সঙ্গে ইউরিয়া ও পটাসিয়াম ফসফেট পাতলা করে গুলে স্প্রে আকারে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সমৃদ্ধ ২০:২০:২০ মিশ্র সার বেশ উপযোগী। সার জলে গুলে সপ্তাহে এক বা দু’দিন গাছে স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার সময় গাছের পাতা যেন ভালভাবে ভিজে যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ফুল সংগ্রহ:
এখন প্রায় সারা বছর ধরেই অর্কিড ফুল উৎপাদন সম্ভব। ভিন্ন প্রজাতি থাকার কারণে অর্কিডের ফুল সারা বছরই বাজারজাতকরণ সম্ভব। গাছ লাগানোর একবছরের মধ্যেই ফুল আসে। মূলত ফুল আসার সময় ফাল্গুন-চৈত্র মাস। অন্যদিকে, টিস্যু কালচার থেকে পাওয়া চারা থেকে ফুল পেতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগে। বাণিজ্যিক চাষের ক্ষেত্রে স্টিকের এক বা দু’টি ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কাটতে হবে। বাগানে বা টবে সৌখিন চাষের ক্ষেত্রে ফুল কাটার প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে গাছে প্রায় ৩০-৪৫ দিন পর্যন্ত ফুল টিকে থাকে। অর্কিড ফুল ফোটার ৩ থেকে ৪ দিন পর পূর্ণতা প্রাপ্ত ফুল সংগ্রহ করা উচিত। খুব সকালে অথবা বিকেলে ফুল কাটা উচিত। বৃষ্টির সময় অথবা ভেজা অবস্থায় ফুল তোলা উচিত নয়। ফুল সংগ্রহের পর ডাঁটা গুলি জলে ডুবিয়ে রাখলে ফুল সতেজ থাকে। প্রতি হেক্টরে প্রথম বছর ৮ হাজার স্টিক, দ্বিতীয় বছর ১৫ হাজার স্টিক এবং তৃতীয় বছর ২৫ হাজার স্টিক পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিবছর গাছ থেকে চারা রেখে ২-৫টি সাকার সংগ্রহ করা যায়।

রোগ পোকা:
অর্কিড চাষের জন্য টব, কন্দ, শিকড় সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। পিঁপড়া, পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর গাছে সেভিন পাউডার প্রয়োগ করা যেতে পারে। থ্রিপস, মিলিবাগ ও এফিডের জন্য ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি ২ মিলি হারে প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ৭-৮ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। ইঁদুরের উপদ্রব হলে বিষটোপ ব্যবহার করা যেতে পারে। পাতা পচা রোগের জন্য প্রতি লিটার জলে ০.৫ মিলি টিল্ট অথবা চা চামচের আধা চামচ ডাইথেন এম-৪৫ ভালভাবে মিশিয়ে প্রতি ৭-১০ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে। ০.৫ মিলি টিল্ট মাপার জন্য সিরাপ জাতীয় ওষুধের সঙ্গে ড্রপার দেওয়া থাকে, তার সাহায্যে মাপা যাবে। নেমাটোড আক্রান্ত গাছের চারপাশে ফুরাডান ছিটিয়ে দেওয়া উচিত এবং চাষের যন্ত্রপাতি শোধন করে ব্যবহার করা ভাল।

[আরও পড়ুন: সাহেব রোগ সারলেই ঢেঁড়শে লক্ষ্মীলাভ, জেনে নিন সঠিক পদ্ধতিতে চাষের কৌশল]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement