shono
Advertisement
Shotyi Bole Shotyi Kichhu Nei Review

সৃজিতের মাস্টারস্ট্রোক 'সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই', পড়ুন রিভিউ

কেন মাস্ট ওয়াচ এই ছবি? জানতে হলে ঝটপট পড়ে ফেলুন রিভিউ।
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 07:07 PM Jan 23, 2025Updated: 12:32 PM Jan 24, 2025

শম্পালী মৌলিক: প্রথমেই বলে দিই, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম সেরা ছবির তালিকায় একদম উপরের দিকে থাকবে 'সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই'। বাসু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত 'এক রুকা হুয়া ফয়সলা' সর্বকালের সেরা কোর্টরুম ড্রামাগুলোর মধ্যে একটা। সেই ছবিকে ভিত্তি করেই সৃজিতের ছবিটি। অন্যদিকে হিন্দি ছবিটির অনুপ্রেরণা ছিল ইংলিশ ড্রামা 'টুয়েলভ অ্যাংরি মেন'। একথা অনস্বীকার্য যে, অনুপ্রেরণা বা অবলম্বনের নিগড় কাটিয়ে 'সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই' স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এত সংলাপ-নির্ভর ছবি অথচ একঘেয়ে লাগে না।

Advertisement

ছবিটি এমন সময়ে মুক্তি পেয়েছে যখন সদ্য রাজ্য তোলপাড় করা একটি নৃশংস কাণ্ডের রায় বেরিয়েছে। ফলত, আদালত, সুবিচার-অবিচার, শাস্তি-অপরাধ, নৈরাজ্য শব্দগুলো দর্শক, পাঠকের মগজে ভিড় করে আছে। সুতরাং আইন এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট যখন পরস্পরের মুখোমুখি অবতীর্ণ, তেমনই সময়ে এই ছবিতে একটি অপরাধ এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারক ও জুরিদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের জোয়ার-ভাটা বিশেষ আগ্রহ উদ্রেক করে। হিন্দি ছবির আশ্রয়ে এই বাংলা ছবিটি হলেও, পরিচালক বর্তমান সময়-সমাজের প্রতিফলন তুলে এনেছেন অব্যর্থভাবে। মূল কাহিনিতে নারীচরিত্র না থাকলেও, ছবিতে দুজন নারীচরিত্রই অপরিহার্য মনে হয়েছে, এত সুন্দর চিত্রনাট্যের বুনট। আর প্রত্যেকটা চরিত্রের নেপথ্য কাহিনি বেশ জোরাল, যে কারণে চরিত্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সামঞ্জস্য রয়েছে ছবিতে। যখনই মনে হবে, এ কেন এমন করছে? পর মুহূর্তেই তার উত্তর পেয়ে যাবেন দর্শক। বিভিন্ন আর্থ সামাজিক স্তরের মানুষ একত্রিত হয়েছেন এখানে। বারোজন চরিত্রের ভিন্ন মত, রাজনৈতিক ভাবনা, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন- ঠোকাঠুকি লেগেছে কিন্তু ছবির তাল কাটেনি। বারো জনের রাগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা, শঙ্কা, দ্বিধা, ঘৃণা, যন্ত্রণা- সমুদ্রের তীরে, রাস্তার ধারে, হলঘরে, জঙ্গলে, বিছিয়ে দিয়েছেন পরিচালক, আর সেখান থেকে উঠেছে ঢেউ- ছবি তরতর করে এগিয়ে গিয়েছে।

হিন্দি ছবিটি অনেকেরই দেখা। তবু এই বাংলা ছবির গল্পটা একটু ধরিয়ে দিই। জেঠুর (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়: ব্রজেশ্বর) বাড়িতে জন্মদিনের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। যে পেশায় প্রধান বিচারপতি। পরদিনই তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার হেয়ারিং। পান-আলাপের ফাঁকে ফাঁকে তার মাথায় ঘুরছে সে কথা। পার্টিতে রয়েছে তার সহকারী (কাঞ্চন মল্লিক), মেয়ে অরুন্ধতী (সৌরসেনী মৈত্র), বন্ধু অর্থনীতিবিদ (কৌশিক সেন), তার স্ত্রী রূপা (অনন্যা চট্টোপাধ্যায়), ইকোনমিস্টের ছেলে গণিতবিদ (সুহোত্র মুখোপাধ্যারয়), এক আত্মীয় (অর্জুন চক্রবর্তী), আরেক ঘনিষ্ঠজন সুমিত (ঋত্বিক চক্রবর্তী), রয়েছে তুখড় অবাঙালি ব্যবসায়ী আগরওয়াল (অনির্বাণ চক্রবর্তী) এবং বাংলা ফোক গায়ক সাদিক (রাহুল)। অনুপস্থিত প্রবীণ হাবুলদা (ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যাবয়), যে নিজেকে প্রচণ্ড অবহেলিত মনে করে। খাওয়াদাওয়া শেষের দিকে বোঝা যায়, রূপা বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে যুক্ত। তার সাংঘাতিক বম্বে প্রীতি, কলকাতায় কিছু হবে না, এমনটাই ভাবে। সুহোত্রর চরিত্রটি বড্ড নিড়বিড়ে ভালোছেলে ধরনের। সুমিত প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক, মুখের ভাষা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে তার। সৌরসেনীর চরিত্রটি ফিল্মমেকার, উগ্রনারীবাদী বলা যায় তাকে। অর্জুনের চরিত্র দারুণ গোছানো, ভাবনাচিন্তা খুব পরিষ্কার। অন্যদিকে কৌশিক সেনের চরিত্রটি বাংলা বাক্যবাণের সঙ্গে সঙ্গে চোস্ত ইংলিশ বলে, ইমোশন কম, সাংঘাতিক লজিকে চলে। রাহুলের চরিত্র সাদিক বস্তিতে বড় হয়ে, কষ্ট করে দাঁড়িয়েছে। এই বিভিন্নরকম মানুষ একজায়গায় জড়ো হয়ে যায়, একটি মামলার সূত্রে।

রেললাইনের ধারের কেস, ভাই-ভাইকে মারার সেই কেস! ব্রজেশ্বরের মাথায় সারা পার্টি জুড়ে ঘুরছে সেই গুরুত্বপূর্ণ কেসের খুটিনাটি। এই খুঁটিনাটিতে জড়িয়ে যায় পার্টিতে আসা বাকি কয়েকজনও। পরে যেন বারোজন জুরি মিলে বসে যায় ওই মামলার চুলচেরা বিশ্লেষণে। শুরু হয় তীব্র চাপানউতোর। একজনের কাছে যা সত্যি, অন্যজনের কাছে তা নাও হতে পারে। একজন সত্যিটাকে যেভাবে দেখছে, অন্যজন উলটোদিক থেকে দেখলে ক্রাইমসিন পালটে যাবে না তো? ১৯ বছর বয়সে দাদাকে ছুরি মেরেছে ছেলেটা, শেয়ারের ভাগ নিয়ে ঝগড়ার পরে। তাহলে তো সে দোষী! একজন বাদে (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সকলেই তাকে গিল্টি ঠাউরে নেয়। ওই একজন এগারো জনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রশ্ন করে চলে- ছেলেটি দোষী কীভাবে, কোন প্রেক্ষিতে? ফলত, প্রত্যেক জুরির মস্তিষ্কের অন্দরের অনেক কণ্ঠস্বর বেরিয়ে আসতে থাকে। শুরু হয় দোষী আর নির্দোষের দ্বন্দ্ব। আমরা দেখতে পাই, এক একটা মানুষের অতীত, পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কীভাবে ঘটনার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, তা ঠিক করে দেয়। বিচার ব্যবস্থা তাহলে কোন পথে যাবে? যে সাদিক বস্তিতে বড় হয়েছে, সে ১৯ বছরের ছেলেটার জীবনের অপারগতা দেখতে পায়। বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ হয়ে মাদ্রাসায় পড়েই আজকে সাদিক প্রতিষ্ঠিত। যখন সুমিত চূড়ান্ত ঘৃণায় তার সম্প্রদায়কে ছোট করে, সাদিক বলে দেয় বিরিয়ানি খাওয়ার সময়, বা গজল শোনার সময়, বা শামিকে নিয়ে নাচার সময় তো অসুবিধা হয় না, এই হিপোক্রিটদের! ঘটনাচক্রে ওই অভিযুক্ত ছেলেটি সেই সম্প্রদায়েরই মানুষ। সুমিতের চোখ ছেলেটিকে দোষী দেখে। সুমিত তো ভয়াবহ দাঙ্গায় টিকে থাকা মানুষ! সৌরসেনীর চরিত্রটি দেখতে পায় ছেলেটির মেয়েদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলার দিকটা কেবল। পরমব্রতর চরিত্রটি দেখে শাসন কখন অত্যাচারে পরিণত হয়, কারণ তার অতীত তাকে তাই দেখায়। কৌশিক সেনের চরিত্রটি খুবই ঠান্ডা এবং যুক্তির লোক, ফলে সে পরিষ্কার প্রমাণ খোঁজে। পরমব্রতর চরিত্র এখানে আলোচনার মূল চালক। নিজ ভাবনায় কঠোর ব্রজেশ্বরের বিপরীতে গিয়ে স্বর তোলার সাহস রাখে সে। কাউকে শাসালেই যে খুন করা হয় না, স্পষ্ট করে দেয়। প্রান্তিক গোষ্ঠীর স্পষ্ট উচ্চারণ ছবিজুড়ে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লড়াই যেমন উঠে এসেছে, তেমন প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষের কথা বলার পরিসর তৈরি করেছে ছবিটি। তাদের অস্তিত্ব, তাদের অধিকার, পছন্দ-অপছন্দের স্পষ্ট নির্ঘোষ সূক্ষ্মভাবে বুনে দিয়েছেন পরিচালক, কেবল একটি মামলার সূত্রে! কে অপরাধী আর কে নিরপরাধ এত সহজেই কি নির্ণয় করা যায়? প্রশ্নটা উঠে আসে বারবার, ব্রজেশ্বরের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে।

ক্লাইম্যাক্স পর্যন্ত একটানে দেখতে হয়। একটা মানুষের বাঁচা-মরা যে তার হাতে! দারুণ বলিষ্ঠ পরিচালনা সৃজিতের। চমৎকার সব ড্রিম সিকোয়েন্স। তেমন দুর্দান্ত সংলাপ। প্রসেনজিৎ চৌধুরির ক্যামেরা, সংলাপ ভৌমিকের সম্পাদনা খুব ভালো। অভিনয়ে কাকে ছেড়ে কার কথা বলব! ঋত্বিক সুমিতের অন্তরের ঘৃণা, অসহায়তা এমন ফুটিয়েছেন মনেই হয় না অভিনয়। নিজের সীমানা অতিক্রম করে চরিত্রের আত্মা ছুঁতে পেরেছেন তিনি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অনড় ব্রজেশ্বরের চরিত্রে অবিকল্প। অনির্বাণ চক্রবর্তী 'আগরওয়াল' হিসাবে দশে দশ। কৌশিক সেন তাঁর চরিত্রে মাখন-মসৃণ। সুহোত্র যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন অনবদ্য। অর্জুন তাঁর চরিত্রে আগাগোড়া সাবলীল। সৌরসেনী খুব ভালো, বিশেষ করে অনির্বাণের সঙ্গে মুখোমুখি সিকোয়েন্সে। অনন্যা এককথায় ব্রিলিয়ান্ট, তাঁর আরও সুযোগ প্রাপ্য। কাঞ্চন তাঁর চরিত্রে যথাযথ। রাহুল প্রায় নিখুঁত 'সাদিক' হিসেবে। ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় স্বাভাবিক অভিনয়ে মন কাড়েন। সবচেয়ে শক্ত ছিল পরমব্রতর কাজ। বাকি এগারোজনের বিপ্রতীপে এগোচ্ছে সে। তারউপর ভিন্ন যৌনতার মুখ। অতি অভিনয়ের প্যাঁচে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। পরমব্রত অতিক্রম করতে পেরেছেন। শরীরী ভাষায় অনেকখানি জাস্টিফাই করতে পেরেছেন চরিত্রটিকে। তবু কিছু ক্লিশে ম্যানারিজমের ভারমুক্ত হলে আরও খুলত তাঁর অভিনয়। ছবির গতে বাঁধা ভাবনার চরিত্রদের থেকে আলাদা হওয়ার সাহস দিলেন। রাপূর্ণা ভট্টাচার্যর কণ্ঠে 'তোমার ঘরে বসত করে' গানটা শুনতে অদ্ভুত সুন্দর। সব মিলিয়ে, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের এই ছবি মিস করা যাবে না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • অভিনয়, চিত্রনাট্য, সম্পাদনা সব মিলিয়ে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ মিস করা যাবে না!
  • এত সংলাপ-নির্ভর ছবি অথচ একঘেয়ে লাগে না।
  • হিন্দি ছবির আশ্রয়ে এই বাংলা ছবিটি হলেও, পরিচালক বর্তমান সময়-সমাজের প্রতিফলন তুলে এনেছেন অব্যর্থভাবে।
Advertisement