shono
Advertisement
Netaji Subhas Chandra Bose

চিনা ঐতিহাসিকদের নতুন তথ্যে প্রশ্নের মুখে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্ব

২০১৭ সালে মোদি সরকার তথ্য অধিকার আইনে তোলা প্রশ্নে বিমান দুর্ঘটনা তত্ত্বকে সমর্থন করে উত্তর দেওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।
Published By: Suchinta Pal ChowdhuryPosted: 01:36 PM Jan 23, 2025Updated: 01:36 PM Jan 23, 2025

শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী: চিন থেকে প্রকাশিত এক চমকপ্রদ তথ্য। যা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু নিয়ে সরকারি অবস্থানের উপর নতুন করে প্রশ্নচিহ্ন ফেলে দিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ। জাপানের ঘোষণা, তাইওয়ানের তাইপেইতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনাতেই প্রাণ হারিয়েছেন জাপানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনামাসা শিদেই-ও। কিন্তু, নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা করার উদ্দেশ্যে লেখা ‘পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস’ থেকে প্রকাশিত নতুন বইয়ে (‘দ্য বোস ডিসেপশন: ডিক্লাসিফাইড’) লেখকদ্বয় অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ উল্লেখ করেছেন, চিনা ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য জাপানিদের দাবির সঙ্গে মেলে না। ধর এবং ঘোষের দাবি, চিনা সামরিক ঐতিহাসিকদের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল শিদেই সেই সময়ে নেতাজির সঙ্গে ছিলেন না। তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে এবং একেবারেই আলাদা একটি ঘটনায় মারা যান। 

Advertisement

ধর এবং ঘোষ আরও বলেন, যেহেতু কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের ঘোষিত অবস্থান হল, তাঁরা নতুন তথ্য পেলেই আবার অনুসন্ধান শুরু করবেন। তাই তাদের উচিত অবিলম্বে এই নতুন তথ্যকে যাচাই করে দেখা। তারা (কেন্দ্র) বলে, ‘সবকিছু পরিবর্তন’ করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে মোদি সরকার তথ্য অধিকার আইনে তোলা প্রশ্নে বিমান দুর্ঘটনা তত্ত্বকে সমর্থন করে উত্তর দেওয়ার পর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক স্পষ্ট করে বলে, এই উত্তরটি মনমোহন সিং সরকারের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেলে তা পরীক্ষা করা হবে। জাপানিদের মতে, নেতাজি, হাবিবুর রহমান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল শিদেইকে নিয়ে মাঞ্চুরিয়াগামী বিমানটি সায়গন (বর্তমানে হো চি মিন সিটি) থেকে ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট যাত্রা করে। ১৮ আগস্ট তাইপেই বিমানবন্দরের ভিতরে বিমানটি টেক অফ করার পর ভেঙে পড়লে নেতাজি ও শিদেই উভয়ই নিহত হন। জাপানিদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাঁদের মৃতদেহ তাইপেইতে দাহ করা হয় এবং তাঁদের অস্থিভস্ম টোকিওতে পাঠানো হয়।

যদিও সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মনোজকুমার মুখার্জির নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর সম্ভাবনা খারিজ করে দেয়। ২০০৬ সালে মনমোহন সিং সরকার কমিশনের রিপোর্ট প্রত্যাখ‌্যান করে নেতাজি এবং শিদেইয়ের একই জায়গায় ও একই দিনে মৃত্যুর ‘গল্প’ বহাল রাখে। ছবছর অনুসন্ধানের পর মুখার্জি কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্যই জাপানিরা নেতাজির মৃত্যুর ভুয়ো খবর প্রচার করেছিল। বিচারপতি মুখার্জি প্রমাণ করেন, এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে একজন জাপানি সৈনিকের মৃতদেহ নেতাজির বলে প্রচার করা হয়েছিল। তিনি তাঁর রিপোর্টে এও বলেন যে, শিদেইয়ের মৃত্যুও প্রমাণিত হয়নি।

চিনা ইতিহাসবিদদের দেওয়া তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ধর এবং ঘোষ মনে করেন যে, জাপানিরা শিদেইয়ের মৃত্যুকে সোভিয়েতের দিকে নেতাজির পালানোর আড়াল হিসাবে ব্যবহার করেছিল। তাঁরা দাবি করেছেন, ডিক্লাসিফাইড নথিপত্রে পাওয়া অন্যান্য প্রমাণের সঙ্গে একসঙ্গে দেখলে এই নতুন তথ্যটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর পুরো তত্ত্বকেই বাতিল করে দেয়। চিনা সামরিক ঐতিহাসিকরা জানিয়েছেন, শিদেই একটি অন্য বিমানে সফর করছিলেন এবং সেই বিমানটি চিনা সৈন্যবাহিনী গুলি করে ধ্বংস করে। নেতাজি নন, অন্য একজন জেনারেলের সঙ্গে শিদেই সমুদ্রে ডুবে মারা যান। চিনা সামরিক ইতিহাসবিদ ঝাং জিশেন এবং জুয়ে চুন্দে তাঁদের বই ‘দ্য পিলার অফ শেম ইন হিস্ট্রি: আ কমপ্লিট রেকর্ড অফ দ্য ডেথস অফ ১৭১ জাপানিজ জেনারেলস হু ইনভেড চায়না’-এ এই ঘটনাটি সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। বইটি ২০০৯ সালে বেজিংয়ের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) প্রেস থেকে প্রকাশিত।

জিশেন এবং চুন্দে সামরিক ইতিহাসের উপর অনেক বই লিখেছেন, যা জাপান-চিন সংঘর্ষের উপর আলোকপাত করে। তাঁদের বই এবং অন্য রচনার উপর ভিত্তি করে বানানো টিভি সিরিজ চিনে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। জিশেন এবং চুন্দে জানিয়েছেন, নেতাজি তাইপেইতে পৌঁছনোর কয়েকদিন আগে থেকেই শিদেই সেখানে ছিলেন। মেজর জেনারেল সুগুরু সাতো ৫ আগস্ট তাইপেইতে শিদেইকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান। ১৮ আগস্ট শিদেই এবং সাতোকে বহনকারী একটি বিমান তাইপেই থেকে টেক অফ করলে তা মার্কিন নৌবাহিনীর রাডারে ধরা পড়ে। আমেরিকানদের সতর্কবার্তা পেয়ে চিনারা শিদেইয়ের বিমানকে আটকাতে তাদের বোমারু বিমান পাঠায় এবং একটি নির্ধারিত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের নির্দেশ দেয়। জাপানিরা সেই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে তাদের বিমানটির উপর গুলি চালানো হয়, যার ফলে সেটি ধ্বংস হয়ে পূর্ব চিন সাগরে ডুবে যায়।

লেখকদ্বয়ের মতে, শিদেইয়ের মৃত্যু নিয়ে চিনা ঐতিহাসিকদের তথ্যকে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই। কারণ, নেতাজি অন্তর্ধান নিয়ে যে রাজনীতি হয়ে চলেছে সেখানে তাঁদের কোনও স্বার্থও নেই। তাঁদের কথায়, “এ কথা জাপানি এবং ভারত সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ আমরা দেখেছি কেমন করে বিচারপতি মুখার্জির রিপোর্টে প্রমাণিত তথ্য – যা আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের দ্বারা সমর্থিত – জোর করে চাপা দিয়েছে।” নতুন বইতে তাঁরা বলছেন, নেতাজি এবং শিদেই ১৮ আগস্ট একসঙ্গে তাইপেই পৌঁছেছিলেন এমন কোনও প্রমাণ নেই। ১৭ আগস্ট সকালে সায়গনে নেতাজির ছবি তোলা হয়েছিল। তারপর শিদেইয়ের সঙ্গে সায়গনে বা তাইপেইতে তাঁর কোনও ছবি নেই।

এছাড়া বিমান দুর্ঘটনার পর শিদেইয়ের কী হয়েছিল, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। তাইপেইতে তাঁর তথাকথিত শবদাহ অনুষ্ঠানে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। জাপান সরকার কখনও তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে কোনও সমসাময়িক নথি সরবরাহ করেনি। শিদেইয়ের মৃত্যু সম্পর্কে জাপানিদের সঙ্গে ভারত সরকারের চিঠিপত্রের ফাইল/রেকর্ডও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি মুখার্জি তাইপেইতে শবদাহের যে নথি উদ্ধার করেন তা প্রমাণ করে যে জাপানিরা দাবি করলেও শিদেই এবং নেতাজিকে সেখানে দাহ করা হয়নি। তাঁরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে শিদেইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি চিনা এবং জাপানিদের কাছে অবিলম্বে উত্থাপন করার জন্য আবেদন করা হয়েছে। কারণ, এটি নেতাজির অন্তর্ধানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • চিন থেকে প্রকাশিত এক চমকপ্রদ তথ্য। যা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু নিয়ে সরকারি অবস্থানের উপর নতুন করে প্রশ্নচিহ্ন ফেলে দিল।
  • লেখকদ্বয় অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ উল্লেখ করেছেন, চিনা ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য জাপানিদের দাবির সঙ্গে মেলে না।
  • বিচারপতি মুখার্জি প্রমাণ করেন, এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে একজন জাপানি সৈনিকের মৃতদেহ নেতাজির বলে প্রচার করা হয়েছিল।
Advertisement