বিশ্বদীপ দে: তাঁর ছবির সঙ্গে অজান্তেই আমাদের পরিচয় ঘটে যায় শৈশবে। ‘সহজপাঠ’ বইয়ে তাঁরই করা ‘লিনোকাট’ দেখে শিল্পের প্রথম উন্মেষ ঘটে জীবনের সকালবেলায়। তবু নন্দলাল বসু কেবল বাংলার নন। এদেশের ইতিহাসের সোনালি অধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে তাঁর নাম। ৭৬তম সাধারণতন্ত্র দিবসের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কি মনে পড়ে যাবে না কিংবদন্তি শিল্পীকে? তবু প্রশ্ন জাগে, আত্মবিস্মৃত বাঙালি কি মনে রেখেছে সেই অবিস্মরণীয় ইতিহাস?
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল। কিন্তু স্বাধীন হলেই তো হল না। সেই স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই মজবুত সাংগঠনিক ভিত্তিপ্রস্তর। আর সেই লক্ষ্যেই রচিত হয় ভারতীয় সংবিধান। ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় প্রস্তাবিত সংবিধান। যা আনুষ্ঠানিক ভাবে কার্যকর হয় ২৬ জানুয়ারি। সেদিন থেকেই এদেশে সংবিধানের শাসন শুরু। আর তাই এই দিনেই পালিত হয় সাধারণতন্ত্র দিবস।
সংবিধান লিখিত হওয়ার পর জওহরলাল নেহরুর স্বপ্ন ছিল ভারতবর্ষের সনাতন রূপ, রং যেন সংবিধানের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকে। আর তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সংবিধানের প্রথম কপিটি ছাপা হবে না। প্রাচীন ভারতীয় পুঁথির মতোই আদ্যন্ত হাতে লেখা হবে সেটি। কে লিখবেন? সেই দায়িত্ব পান প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদা। স্বনামধন্য এক ক্যালিগ্রাফার। নেহরু জানতে চান, তিনি এর জন্য কত সম্মানদক্ষিণা প্রত্যাশা করেন। জবাবে প্রেমবিহারী বলেন, ''একটি পয়সাও চাই না। ঈশ্বরের দয়ায় আমার সবই আছে। আমি আমার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু আমার একটি দাবি রয়েছে। সংবিধানের প্রতিটি পাতায় আমি আমার নামটি লিখে দেব। আর শেষ পাতায় আমার নামের সঙ্গে থাকবে আমার পিতামহের নাম।'' তবে মূল সংস্করণটির ক্যালিগ্রাফি তিনি করেও হিন্দি সংস্করণটির দায়িত্বে ছিলেন বসন্তকৃষান বৈদ্য।
কিন্তু কেবল সুলিখিত হলেই তো হবে না। পাতায় পাতায় চাই শৈল্পিক স্পর্শ। সেই দায়িত্ব কে নেবেন? জওহরলালের মনে পড়ে যায় নন্দলালকে। কেন তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল এই দায়িত্ব? সম্ভবত দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ছিল কয়েক বছর আগের কথা। ১৯৩৮ সালে হরিপুরা কংগ্রেসের মঞ্চ সাজানোর দায়িত্ব নন্দলালকেই দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গুজরাটের সেই গ্রামেই সেবার বসেছিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। অসংখ্য পোস্টার তৈরি করেন নন্দলাল। হ্যান্ডমেড পেপারে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে অসামান্য শিল্পরূপ সৃষ্টি করেন তিনি। শিকারী থেকে সুরকার, ছুতোর কিংবা তাঁতি- সাধারণ মানুষের ছবিতেই তিনি চমকে দেন। আলাদা করে বলাই যায় সৈকতে ধরে গান্ধীর হেঁটে যাওয়ার ছবিটির কথা।
আসলে নন্দলাল বসুর কাছে শিল্পসৃষ্টি ছিল উপাসনার মতো। শোনা যায়, ছবি আঁকায় মগ্ন শিল্পীকে দেখলে মনে হত যেন ধ্যানরত কোনও তপস্বী! আঁকার সরঞ্জামের পাশেই শোভিত হত একটি জলের পাত্র। সেখানে ভাসত ফুল। জ্বলত ধূপ। ফলে সুগন্ধে ম ম করত চারদিক। তাঁর ছবি আঁকা যেন অনন্তের সাধনা। সহজের মধ্যে সত্যকে স্থাপন করার এমন দক্ষতা কজনেরই বা থাকে। এহেন শিল্পীকেই তাই মনে পড়ে গিয়েছিল জওহরলালের। আধুনিক ভারতীয় শিল্পের অন্যতম অগ্রদূতের হাতেই তিনি সঁপেছিলেন হাতে লিখিত সংবিধানের পাতায় পাতায় সনাতন ভারতবর্ষকে চিত্রিত করার দায়িত্ব। সেই সময় শান্তিনিকেতনেই ছিলেন শিল্পী। তিনি সানন্দে রাজি হলেন এমন প্রস্তাব পেয়ে। সঙ্গে রাখলেন কলাভবনেরই কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। যাঁর মধ্যে অন্যতম তাঁর ছাত্র জবলপুরের বেওহর রামমনোহর সিং। যদিও পুরো বিষয়টির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নন্দলালই।
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক রংকে ব্যবহার করে কাজটি করেছিলেন নন্দলাল। এঁকেছিলেন মোট ২২টি ছবি। পুরাণ থেকে ইতিহাস ছুঁয়ে স্পর্শ করেছিলেন এদেশের অন্তরাত্মাকে। কী কী ছবি ছিল সেই তালিকায়? রামায়ণ-মহাভারত থেকে টিপু সুলতান, বুদ্ধ, সম্রাট অশোক থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, রথের দৌড়- অসামান্য সব ছবি এঁকেছিলেন। যা আজও নন্দলাল বসুর শিল্পসৌকর্যকেই তুলে ধরে। এদেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকে এভাবে চিত্রিত করা ছিল কত কঠিন! অথচ তিনি তা করেছিলেন যেন অপরিসীম সহজতায়। পরবর্তী সময়ে ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী পুরস্কারের প্রতীকগুলির নকশাও নির্মাণ করেছিলেন তিনিই। মানচিত্রগুলির সচিত্রকরণও তাঁর হাতেই। সেই সমস্ত কাজ মৃত্যুর কয়েক দশক পরেও তাঁকে 'জীবন্ত' করে রেখেছে শিল্পানুরাগী জনমানসে।
আরও এক সাধারণতন্ত্র দিবসে পৌঁছে ভারতীয় সংবিধানের রূপকারদের পাশাপাশি নন্দলাল বসুকেও স্মরণ করা আমাদের অবশ্যকর্তব্য। সেই সঙ্গে নতজানু হতে হবে প্রেমবিহারী নারায়ণ রায়জাদার মতো অসামান্য ক্যালিগ্রাফি শিল্পীর সামনেও। তাঁদের যৌথ পরিবেশনায় নির্মিত হয়েছিল সংবিধানের প্রথম কপি। আদ্যন্ত হাতে লেখা ও আঁকা সেই কপি আজও বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়। ভাবায়। শ্রদ্ধাবনত করে রাখে।