কুণাল সরকার (কার্ডিয়াক সার্জন): বাঙালি জেনে ফেলল আরও একটা নতুন অসুখের নাম। ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ। অবশ্যই সৌরভের (Sourav ganguly) দৌলতে। যদিও চিকিৎসকদের কাছে এটা নতুন নয়। বহু পুরনো। হার্টের তিনটে আর্টারি ব্লক হলে তাকে ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ বলা হয়।
ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ:
একটা ছোট্ট উদাহারণ দেওয়া যায়, প্রতি বছর যত রোগী হার্ট ব্লকের সমস্যা নিয়ে আসেন, তার মধ্যে ৬০ শতাংশই ট্রিপল ভেসেল ডিজিজ। একটা লোহার কাঠামোয় জং ধরলে একটা অংশে ধরবে তা তো নয়। সাধারণত তিনটে আর্টারি বা ভেসেল যখন বন্ধ হয়ে যায়, তার মধ্যে একটা থাকে ‘কালপ্রিট ভেসেল’। মানে এই মুহূর্তে যে ঝামেলাটা পাকাচ্ছে। সৌরভের সেই কালপ্রিট ভেসেল থুড়ি ডানদিকের আর্টারিতেই শনিবার স্টেন্ট বসানো হয়েছে। হার্টের আর্টারিগুলো দিয়ে রক্ত চলাচল করে। সেই পাইপগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদ তো হবেই। মহারাজের হৃদযন্ত্রের মাংস পেশি রক্ত পাচ্ছিল না। হৃদযন্ত্রের মাংস পেশি প্রয়োজন অনুযায়ী রক্ত না পেলেই বিপদ। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। হার্টের কাজই হচ্ছে রক্ত পাম্প করে শরীরের নানা জায়গায় পাঠানো। রক্তের অভাবে হার্টের পেশি যদি স্বাভাবিক কাজ না করে সে রক্ত পাম্প করবে কী করে?
আচমকা হার্ট অ্যাটাক হলে লাইফ রিস্ক ফ্যাক্টর তৈরি হয়। অর্থাৎ জীবনের ঝুঁকি। সেটা কখনওই ত্রিশ শতাংশের কম নয়। সৌরভকে যে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে এটাই বাঁচোয়া। ওখানে প্রথমে ওর ইসিজি হয়েছে। সেখানেই দেখা যায় আশঙ্কাই সত্যি। হৃদযন্ত্রের পেশি গন্ডগোল করছে। ঠিক কোন কোন জায়গায় গন্ডগোল করছে তা দেখতে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা হয়। তারপর দ্রুত স্টেন্ট বসানো হয়েছে। মাথায় রাখতে হবে একটা শর্ট টার্ম প্রবলেম ঠিক হয়েছে। তিনজন শত্রুর মধ্যে একজনকে সরিয়ে দেওয়া গিয়েছে। অন্য দুটো ব্লকে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হবে কি না তা নির্ভর করবে সেই ব্লকগুলোর গঠনের ওপরেই। খুব জটিল ব্লকেজ থাকলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি না করাই শ্রেয়। বাইপাস করাটাই ভাল। এটা আমার কথা নয়। সারা পৃথিবীর খ্যাতনামা কার্ডিও সার্জনরাই মনে করেন বাইপাস সার্জারি করলে দীর্ঘদিন সুস্থ স্বাভাবিক থাকা যায়। সারভাইভাল রেটও বাইপাস সার্জারিতে অনেক বেশি।
কেন করা হয় অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি?
হৃদযন্ত্রের আর্টারিগুলো পাইপের মতো। তার মধ্যে ছোট ছোট ব্লক থাকলে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করা যায়। কিন্তু লম্বা লম্বা বাঁকাচোরা ব্লক থাকলে চোখ বন্ধ করে বাইপাসই ভরসা। আরও একটা কথা শুনলাম। রবিবার নাকি ওর আবার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার কথা। আমার মনে হয় এটা ঠিক হবে না। পরপর দু’দিন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি না হওয়াই শ্রেয়। অনেকেই এই খবরটা দেখে ভাবছেন দাদা এত ফিট, তারও যদি এই অবস্থা হয়!
কেন এমনটা হল সৌরভের?
আমি জানি সৌরভ সিগারেট খায় না। ওর ডায়াবেটিস নেই। তাও কেন ওর হার্ট ব্লক হল? ১০০ জনের মধ্যে ৩০ জন এমন রোগী আমরা পাই যাঁরা সমস্ত নিয়ম মেনে চলেও হার্ট অ্যাটাকের শিকার। এর মানে সিগারেট, মদ, ডায়াবেটিস ছাড়া আরও কোনও রিস্ক ফ্যাক্টর আছে। এ নিয়ে আমাদের আরও গবেষণা প্রয়োজন। পারিবারিক ইতিহাস একটা কারণ। ওর পরিবারে হার্ট অ্যাটাকের একটা ইতিহাস আছে।
অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হলে ও হাসপাতাল থেকে তিন চার দিনের মধ্যে বাড়ি চলে যাবে।
আগামিদিনে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে?
আগামিদিনে খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ওকে। ও তো খুব খেতে ভালবাসে। বছরে ওকে কম করে তিনবার হেলথ চেকআপ করতে হবে। যতই কাজের চাপ থাক। বাদ দিতে হবে সব ধরনের রেড মিট। আইসক্রিমে হাত লাগানো বারণ। প্রায়ই কাজের প্রয়োজনে ওকে বিদেশ যেতে হয়। তবে এবার সসেজ, হ্যামবার্গ ছোঁয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে। সমস্ত ফাস্টফুড কোল্ড ড্রিঙ্কস থেকে দূরে থাকো মহারাজ। সৌরভের চেহারা যদিও দারুণ ফিট। খেলাধুলো ছাড়ার পরেও এতটুকু মোটা হয়ে যায়নি। আমার মনে হয় না খাওয়া দাওয়ার নিয়ম মানতে ওর খুব অসুবিধা হবে। চিকিৎসকরা প্রত্যেক ছ’মাস অন্তর দেখবেন সৌরভের হার্ট ঠিকমতো কাজ করছে কি না। যে ব্লকেজগুলো সারানো হয়েছে সেগুলোয় আবার কোনও গন্ডগোল হচ্ছে কি না দেখতে হবে। কারণ সরু হয়ে যাওয়া আর্টারির পাইপগুলোকে আমরা চাপ দিয়ে বড় করব, কিন্তু কেন সরু হল তার কারণটা কিন্তু আমাদের হাতে নেই।