অর্পণ দাস: আচ্ছা, বলুন তো বিরাট কোহলি, ফিরহাদ হাকিম ও আলিয়া ভাট- ক্রীড়াক্ষেত্রে এঁদের মধ্যে মিল কোথায়? কোহলি ক্রিকেটের 'কিং', কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ক্রীড়ানুরাগের কথা অজানা নয়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে বলি অভিনেত্রীকে আলিয়া ভাটকে খেলার দুনিয়ায় মিলিয়ে দেখা একটু মুশকিল, তাই না? রহস্য না করে বলেই দেওয়া যাক। তিনজনকেই কোনও না কোনও সময় পিকেলবলের কোর্টে দেখা গিয়েছে।
পিকেলবল। নামটা হয়তো ক্রিকেট, ফুটবল, এমনকী টেনিসের মতো জনপ্রিয় নয়। কিন্তু এই খেলার পরিসর যত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ভারতে জনপ্রিয়তায় অনেক বড় খেলাকে টেক্কা দেওয়ার জায়গায় চলে আসছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের একটা বড় অংশ কিন্তু এই খেলার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত। তার মানে এই নয় যে, পিকেলবল তরুণ প্রজন্মের খেলা। বিভিন্ন কর্পোরেট সেক্টরে কর্মরত চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের নিত্য আনাগোনা পিকেলবল কোর্টে। এখানেই শেষ নয়। আইপিএলের ধাঁচে এবার হচ্ছে পিকেলবল প্রিমিয়ার লিগ। দেশ-বিদেশের পিকেলবল খেলোয়াড়রা যোগ দিয়েছেন সেখানে।
বাদ যান না সেলিব্রিটিরাও। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর হয়ে পিকেলবল কোর্টে নেমেছিলেন কোহলি। ২০২৪-এ উত্তর কলকাতার একটি পিকেলবল কোর্ট উদ্বোধনে গিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। আলিয়া ভাটকে পিকেলবল খেলতে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ভক্তরা। এই তালিকা দীর্ঘ করাই যায়। আসল ব্যাপার হল, পিকেলবল নিয়ে বিভিন্ন মহলে উন্মাদনা তুঙ্গে উঠতে শুরু করেছে।
আইপিএলের ধাঁচেই দিল্লির কেডি যাদব স্টেডিয়ামে চলছে ইন্ডিয়ান পিকেলবল লিগ। এবারই এর প্রথম মরশুম। ৬টা দল খেলছে এবারের লিগে। বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, গুরুগ্রাম থেকে ফ্র্যাঞ্চাইজি দল এতে অংশগ্রহণ করেছে। বিদেশি প্লেয়াররাও খেলছেন বিভিন্ন দলের হয়ে। লিগ পর্বের ম্যাচের পর এলিমিনেটর ও সবশেষে ফাইনাল।
কলকাতা থেকে দল নেই ঠিকই, তবে ভারতে পিকেলবল উন্মাদনায় তিলোত্তমার ভূমিকা কম নয়। তার আগে পিকেলবলের ইতিবৃত্ত ও নিয়মকানুন একটু সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যের বেনব্রিজ আইল্যান্ডের জো প্রিটচার্ড, বিল বেল ও বার্নি ম্যাকালাম ছোটদের জন্যে একটি নতুন খেলা আবিষ্কারের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেখান থেকে টেনিস ও টেবিল টেনিসের মিশ্রণে তৈরি হয় 'পিকেলবল'। এর নামকরণের ইতিহাসও অভিনব। বলা হয়, খেলতে খেলতে তাঁদের কুকুর 'পিকেল' খেলার বলগুলো নিয়ে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে পিকেলবল নামটি আসে। সেই নিয়ে ভিন্নমতও আছে। সে যাই হোক না কেন, সাতের দশকে পিকেলবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হয়।
তবে ভারতে পিকেলবল আসে এই সহস্রাব্দে। উইকিপিডিয়া বলছে, ২০০৬ সালে সুনীল ভালাভাকার ভারতে এই খেলা নিয়ে আসেন। তবে পরিচিতি পেতে বেশ খানিকটা দেরি হয়। ২০০৮ সালে সর্বভারতীয় পিকেলবল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা হলেও কোভিড-পরবর্তী সময়ে 'সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ফ্রেন্ডলি' খেলা হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। তারপর থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পিকেলবল লিগ আয়োজিত হয়েছে। কলকাতা শহরের বিভিন্ন কোর্টে নিয়মিত পিকেলবল টুর্নামেন্ট চলে।
১১:১১ পিক এ কোর্ট
খেলার নিয়মকানুন খুব কঠিন কিছু নয়। মূলত প্যাডলের মতো ব্যাট। অনেকটা ছোটদের 'প্লাস্টিক র্যাকেট'-এর মতো, টেবিল টেনিস ব্যাটের থেকে একটু বড়। ব্যাডমিন্টনের মতো কোর্ট, তবে নেট থাকে নীচের দিকে। সার্ভিস হবে আন্ডারহ্যান্ড। শুধুমাত্র সার্ভিং দলই পয়েন্ট পেতে পারে। তবে বিপক্ষকে ওই সেটে হারাতে পারলে অন্যদল সার্ভ করার সুযোগ পায়। সাধারণত ১১ পয়েন্ট পর্যন্ত খেলা হয়। তবে জেতার জন্য প্রতিপক্ষের চেয়ে কমপক্ষে ২ পয়েন্টে এগিয়ে থাকতে হবে। স্কোর বলার সময় তিনটি সংখ্যা বলা হয় (যেমন: ৩-১-১)। প্রথমটি সার্ভিং দলের, দ্বিতীয়টি রিসিভিং দলের ও তৃতীয়টি ডাবলসে কোন খেলোয়াড় সার্ভিস করছে, তা বোঝায়। এছাড়া ডবল বাউন্স, ফল্ট বা কিচেন রুলের মতো নিয়মকানুন আছে।
কিছু নিয়ম অচেনা থাকলেও শিখে নেওয়া কঠিন কাজ নয়। সেই কারণে জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত বাড়ছে। সেই সঙ্গ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কলকাতা বা হাওড়ায় পিকেলবল কোর্টের সংখ্যাও। গুগলে কলকাতায় পিকেলবল কোর্ট লিখে সার্চ করলে একাধিক জায়গার সন্ধান মিলবে। সেরকমই কথা হচ্ছিল, বেহালার '১১:১১ পিক এ কোর্টে'র কর্ণধার মুক্তামুখী চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, খেলাটা সহজ বলেই জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সহজ অর্থে ক্রিকেট-ফুটবল-টেনিসের মতো শারীরিকভাবে কষ্টসাধ্য নয়। সেই কারণে বিভিন্ন বয়সের পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে খেলাটার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। ঠিক কোন বয়সিরা আসেন খেলতে? মুক্তামুখীর মতে, ৭৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তিও নিয়মিত আসেন তাঁদের কোর্টে। আর সব পেশার মানুষেরই মন মজেছে এই খেলায়। ডাক্তার, উকিল, কর্পোরেট সংস্থার প্রধান, কেউই বাদ যান না। একসময় তাঁর পিকেলবল নিয়ে অনীহা ছিল, আজ তাঁর নিজের একটি কোর্ট আছে। একটি বিষয় তিনি জোর দিয়ে বলছেন, "পিকেলবল একটা ট্রেন্ডের মতো চলছে। তরুণ প্রজন্ম নেটদুনিয়ায় ডুবে না থেকে অন্তত খেলার মাঠে আসুক। ছোট পরিসরে ও সহজ হওয়ায় পিকেলবল সেই কাজটা করে দিচ্ছে।"
১১:১১ পিক এ কোর্ট
