রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়, রাজকোট: বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল…
মনোজ তিওয়ারির আজ সব কিছু এক এক করে মনে পড়ছে। বাংলার জার্সিতে জীবনের প্রথম ম্যাচ, শেষ রনজি ফাইনালে ব্যাট করার সময় স্লিপ থেকে মুম্বইয়ের ওয়াসিম জাফরের টিপ্পনী, বন্ধুত্বের মুখোশে সমালোচকদের মুখ- ভিড় করে আসছে সব। ভেবেছিলেন, এই রনজিতে ট্রিপল সেঞ্চুরির ব্যাটটা নিয়ে নামবেন ফাইনালে। কিন্তু ভেঙে গিয়েছে ওটা। নতুন ব্যাট নিয়ে নামবেন ফাইনালে। নিজের শততম রনজি ম্যাচে। আজ থেকে যে উইলোই হবে তাঁর সুহৃদ, ঈশ্বরসম পিতা-মাতা। “ফাটা আঙুল নিয়ে খেলছি। আশা করছি, আমার এই বন্ধু আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। রনজি ট্রফিটা এবার বাংলাকে দিতে পারলে কোনও অনুতাপ আর থাকবে না জীবনে। জানব, যে বাংলা আমাকে এত কিছু দিয়েছে, সেই বাংলাকে আমি কিছু তো ফিরিয়ে দিতে পেরেছি,” ছেলে যুবানের নাম লেখা ব্যাটটাকে আত্মজের মতো জড়িয়ে থাকেন মনোজ।
আচ্ছা, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে মাথা নিচু করে যিনি হেঁটে যাচ্ছেন, তিনি অনুষ্টুপ মজুমদার না? উনি অনুষ্টুপ মজুমদারই! যিনি গতরাত থেকে ঘুমোতে গেলে একটা স্বপ্নই দেখছেন- রনজি ট্রফি জয়! জিজ্ঞাসা করলে রনজি কোয়ার্টার আর সেমিফাইনালের মহানয়াক সলজ্জ উত্তর দেন, “আমি ভারত খেলিনি। রনজি ফাইনাল খেলিনি। বাংলাই তাই আমার কাছে ভারত, রনজি ফাইনালই আমার কাছে বিশ্বকাপ ফাইনাল! বাংলা খেলব বলে চাকরি ছেড়েছি। সর্বস্ব তো দিতেই হবে!” রবিবাসরীয় দুপুরে আবেগঘন অনুষ্টুপকে দেখলে মনে হয়, পরজন্ম বলে কিছু থাকলে, তিনি আবার আসিবেন ফিরে, ক্রিকেট মাঠের ভিড়ে, এই বাংলায়!
[আরও পড়ুন: ঘরের মাঠে ফের ধামাকা, বেঙ্গালুরুকে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে এটিকে]
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ…
ঋদ্ধিমান সাহা জানেন, বাড়িতে ফিরে অশেষ দুঃখ কপালে আছে! গত পরশু সদ্যোজাতের জন্ম হয়েছে। অথচ তিনি, নিউজিল্যান্ড সফর ফেরত ঋদ্ধিমান সাহা তার চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময়ে উড়ে এসেছেন রাজকোট, রনজি ফাইনাল খেলতে! “রোমি (স্ত্রী) জানত, আমাকে বলে লাভ নেই। জানত, ফাইনাল খেলতে আমি আসবই,” প্র্যাকটিস শেষে হাসছিলেন ঋদ্ধিমান। আপনি ভারত খেলছেন, তবু রনজি ফাইনাল খেলবেন বলে এত আত্মত্যাগ? “আশ্চর্য। আমি যে আজ ভারত খেলছি, আইপিএল খেলছি, কীসের জন্য খেলছি? বাংলার হয়ে রনজি খেলেছি বলেই তো, নাকি? তার উপর এটাই আমার প্রথম রনজি ফাইনাল!” একরাশ বিস্ময় নিয়ে পালটা দেন সুপারম্যান সাহা। কিন্তু চেতেশ্বর পূজারা-জয়দেব উনাদকট সামলে জেতা যাবে? চোখ পাকিয়ে উত্তর আসে, “সন্দেহ আছে?” ভারতীয় টেস্ট কিপারের থেকে এরপর স্বতন্ত্র এক আবেগ অনুরণন অনুভূত হয় না? পাওয়া যায় না ঘর-হাট-বন-মাঠের সোঁদা গন্ধ? যা শুধুমাত্র বাংলার, বাঙালির?
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা…
ঈশান পোড়েল ঠিক করে ফেলেছেন, পূজারাকে পেলে ভাল, নইলে উলটোদিকের উইকেটগুলো তুলতে হবে! “একটা পূজারা দিয়ে জেতা যায় নাকি?” ড্রেসিংরুমের সামনে মোবাইল দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেন অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বজয়ী ভারতের পেসার। পাশ থেকে আচম্বিতে এবার গর্জন করে ওঠেন মিতবাক মুকেশ, শুনে যে পূজারা বলেছেন তাঁর ইনসুইংয়ে সমস্যা নেই। “বলেছে ভাল। সেটা নিজের কনফিডেন্স বাড়াতে বলেছে। কিন্তু আমি ওকে ইনসুইংয়েই আউটটা করব!” শুনলে শিহরণ জাগে, বাড়ে বিশ্বাস। নিঃসন্দেহে, মনোজদের বাদ দিলে এই পেস ত্রয়ীই বাংলার রনজি জয়ের শ্রেষ্ঠ বাজি। ঈশান-মুকেশ-আকাশ। ঈশান এঁদের মধ্যে নিখাদ বাঙালি। মুকেশ-আকাশ বিহারজাত। কিন্তু কবে যে বঙ্গপ্রদেশে থাকতে থাকতে বাংলা একান্ত আপন হয়ে গিয়েছেন, নিজেরাও জানেন না। মুকেশকে হিন্দিতে প্রশ্ন করলে ঝরঝরে বাংলায় উত্তর আসে। আজকাল আকাশও দেখা যাচ্ছে ভাঙা বাংলায় বলছেন যে, “বাংলা খেলব আর বাংলা বলব না, হয় নাকি?”
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন…
সব সোমবার থেকে আগামী পাঁচদিন একজোট হচ্ছেন। কেউ প্রাক্তন ক্রিকেটার, কেউ আমজনতা, কেউ ও পার বাংলার। ঠিকই, ওপার বাংলা থেকেও দোয়া আসছে এপারের রনজি জয়ের। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছে। যাক গে, এপারের আবেগ, প্রার্থনায় আসা যাক। ’৮৯-এ রনজিজয়ী বাংলা অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক করে ফেলেছেন যে, ড্রয়িংরুমের নির্দিষ্ট এক চেয়ারে বসে তিনি রনজি ফাইনালটা দেখবেন! খেলতেন যখন, নানা সংস্কার মানতেন সম্বরণ। সেটা আবার চলবে। ফোনে সঙ্গে জুড়ে দিলেন, “ছেলেরা শুধু রিল্যাক্সড থাকুক, ব্যস।” শেষবার রনজি ফাইনালিস্ট বাংলার অধিনায়ক দীপ দাশগুপ্ত আবার বলছিলেন যে, আগামী সপ্তাহে তাঁর ফোনের ব্যাটারির বারোটা বাজবে! ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে কমেন্ট্রি করবেন। কিন্তু স্কোর নাগাড়ে চেক করবেন মোবাইলে! আর সিএবি? শোনা গেল, খেলার দু’দিন দেখে ঠিক হবে, কতজন আসবেন, কবে আসবেন? তবে হ্যাঁ, সিএবি যুগ্ম সচিব দেবব্রত দাস যাচ্ছেন কালীঘাটে পুজো দিতে! রনজি ট্রফির প্রার্থনায়!
রবিবাসরীয় রাজকোট ঘুরে সব দেখলে-শুনলে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো আবেগ শরীর-মনের দখল নিতে বাধ্য! বাংলা কোচ অরুণ লাল আবার ঠিক সেটাই চান না। প্রখর বাস্তবে পা রেখে আবেগের তুষারপাত থেকে টিমকে বাঁচাতে চান। ফাইনালে ওঠার সময় থেকে তো তিরিশ বছর রনজিজয়ী টিমের সঙ্গে এবারের টিমটার মিল খোঁজা চলছে। বলা হচ্ছে, সেই টিমের অনেকে এবার এই টিমের সঙ্গে জড়িয়ে। স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অরুণ লাল-অমুক, তমুক। রাজকোটে এসে নতুন একটা জুড়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক চললে, রনজি ফাইনালে ওপেনিংয়ে অভিষেক ঘটতে চলেছে সুদীপ ঘরামির। ঠিক তিরিশ বছর আগের কোনও এক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো!
“কীসের তিরিশ বছর? কীসের মিল? ও সব ভুলে গিয়েছি। বাড়িতে আসুন আমার। দেখবেন সেই রনজি জয়ের কোনও স্মৃতি পড়ে নেই। এবার জিতলেও কিছু থাকবে না। সব আবার সরিয়ে দেব। আমার কাছে বর্তমান আর ভবিষ্যতই সব,” কাটা কাটা ভাবে বলে দেন অরুণ। যাঁর কাছে রাজকোট পিচ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক সেই পিচের টিম কম্বিনেশন।
[আরও পড়ুন: ফাইনালে আচমকা ব্যাট হাতে রিচা, দলের হারে মাঠে মারা গেল সেলিব্রেশনের আয়োজন]
সোজাসুজি বলা যাক। রাজকোটে ঘাস-টাস প্রায় পুরো ছেঁটে চেতেশ্বর পূজারার প্রিয় পিচে বাংলাকে রনজি ফাইনালে নামাতে চলেছে সৌরাষ্ট্র। ‘লাইভ ম্যাচ, সবাই দেখবে’ বলেও কোনও লাভ হয়নি। এবং অসহযোগিতাও চলছে নিরন্তর। সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলা সত্ত্বেও ঠিকঠাক কোনও নেট বোলার এ দিন পায়নি বাংলা। দু’একজন ঝড়তিপড়তিকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজকোট পিচ নিয়েও বাংলা কিছুটা চটে। কিন্তু কিছু করার নেই। যা খবর, তিন পেসারের দুই স্পিনার অলরাউন্ডার শাহবাজ আহমেদ আর অর্ণব নন্দীকে নিয়ে নামছে বাংলা। আর শ্রীবৎস গোস্বামীর জায়গায় ঢুকছেন ঋদ্ধিমান সাহা। রাতের দিকে বঙ্গ শিবিরে খোঁজ চালিয়ে শোনা গেল, ক্রিকেটারদের কবিতা শোনাচ্ছেন অরুণ লাল। টিমকে রিল্যাক্সড রাখতে। সবাইকে বলাও হচ্ছে যে, ফাইনাল নয়। নিছকই তারা রনজিতে একটা সৌরাষ্ট্র ম্যাচ খেলতে নামছে!
অভিনব? হোক না, চলুক। যেভাবে আসার আসুক, এলেই হল। দিন শেষে সমবেত প্রার্থনা তো একটাই। জয় হউক, জয় হউক, জয় হউক, হে ভগবান!
The post রনজি তুমি কার! ইতিহাস ছুঁতে আজ আবেগের ফাইনালে নামছে বাংলা appeared first on Sangbad Pratidin.