shono
Advertisement

শাস্ত্রী-কোহলি বিদায়ী আবেগে যেন ঢেকে না যায় রুক্ষ ময়নাতদন্ত

দ্বিপাক্ষিক সিরিজে রাজা। আইসিসি টুর্নামেন্ট এলেই প্রজা শাস্ত্রী-কোহলির দল।
Posted: 12:12 PM Nov 09, 2021Updated: 12:46 PM Nov 09, 2021

গৌতম ভট্টাচার্য: রবিশঙ্কর জয়দ্রথ শাস্ত্রীকে (Ravi Shastri) কোচ করার জন্য একটা সময় প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার আকুল আগ্রহ দেখে সংশয় হত, পুরোনো কোনো সিদ্ধান্তের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছেন বলে কি এত গরজ? এহেন ডালমিয়ার আমলেই ক্রিকেটীয় যুক্তি ও বুদ্ধিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মহম্মদ আজহারউদ্দিনকে দশবছর ভারতীয় অধিনায়কত্বে রেখে দেওয়া হয়েছিল। এর তিনবছর শাস্ত্রী থেকেছেন সহ অধিনায়ক। এর আগে বেঙ্গসরকার-শ্রীকান্তের জমানাতেও তিনি ভাইস ক্যাপ্টেন। আজহারের নাম ওঠারই কথা নয়। তবু ডালমিয়া-রাজ সিংহরা কেন বেছে নিয়েছিলেন নতুন প্রার্থীকে? ঠিক যে কারণে চেতন শর্মা আজকের নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান। কথা শুনবে বলে। যাগ গে যাক-নব্বই দশকে দু’বার ডালমিয়াকে প্রত্যাখ্যান করার পর তাঁর জমানাতেই শাস্ত্রী যখন কোচ নির্বাচিত হন, মনে হয়েছিল ক্যাপ্টেন হিসেবে যা দেশকে দেওয়ার সুযোগ পাননি তাই দেবেন কোচ হয়ে। ভারতীয় ক্রিকেটের ছায়াপথ বদলে যাবে তাঁর হাত ধরে।

Advertisement

আন্দাজ করার চেষ্টা করছি তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে মোট ১৮৪ ম্যাচের শাস্ত্রী কোচিং জমানা শেষ হওয়ার রিপোর্ট কার্ড কীভাবে বানাতেন প্রয়াত কিংবদন্তি প্রশাসক? টেস্ট ম্যাচের পারফরম্যান্স সম্পর্কে অবশ্যই উচ্চকিত থাকতেন। টানা দুটো সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার মাঠে জিতে আসা ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্য। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার কৃতিত্ব আর ৪৩ টেস্টের ২৫ ম্যাচ জিতে শেষ করাকে খুব কড়া পরীক্ষকও লেটার মার্কস দেবেন। ২০১৪-তে প্রথম টিমের সঙ্গে যুক্ত হন শাস্ত্রী। ইংল্যান্ড সিরিজের পর ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকা টিমকে টেনে তোলেন। সাত নম্বর টিম একে উঠে আসার ঝাড়লণ্ঠনেই মায়াবী আলো দেখানো শুধু নয়, শাস্ত্রীয় সংস্পর্শে পুনর্জন্ম ঘটে ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির। বোথাম যেমন ব্রিয়ারলিতে মজে ছিলেন তেমনি শাস্ত্রীতে আকর্ষিত হয়ে পড়েন কোহলি। আর আবাহন হয় ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম প্রভাবশালী কোচ-ক্যাপ্টেন রাজত্বের। সোমবার দুবাইতে নামিবিয়া ম্যাচ দিয়ে যার অন্তিম বিসর্জন হয়ে ক্রিকেট ইতিহাসে বন্ধ পাতা হিসেবে ঢুকে গেল। 

[আরও পড়ুন: T-20 World Cup: বিশ্বকাপের বিদায়ী ম্যাচে নয়া মাইলস্টোন ছুঁলেন রোহিত, নামিবিয়াকে হারিয়ে দেশে ফিরছে ভারত]

কীভাবে মাপা হবে এই জুড়িকে? কীভাবে মাপা উচিত? ডালমিয়া তাঁর চূড়ান্ত মার্কশিটে কী লিখতেন? তাঁকে যতদূর চিনেছি, এদিনের প্রাক ম্যাচ শাস্ত্রী ইন্টারভিউ দেখলে চোখটা সামান্য নামিয়ে বলতেন, এই রাহুল দ্রাবিড়কে একটু ফোনে ধরো তো! নতুন কোচকে নিজের চেম্বারের বিখ্যাত লাল ল্যান্ডলাইন ফোনে বোঝাতেন, এখুনি যা শুনলেন তার কোন কোন অংশের তিনি পুনরাবৃত্তি চান না। সম্ভ্রান্ত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী। আদ্যন্ত প্রাকটিক্যাল। অস্তগামী সূর্যে যিনি আচ্ছন্ন না হয়ে বলতেন, ওটা এমন কী? লোকে দু এক মিনিট বলবে, দারুণ দৃশ্য। তারপর ভুলে যাবে। বলবে দিনের আলোই আসল। সেই ডালমিয়া অবশ্যই ঘনিষ্টদের বলতেন, এই যে একটু আগে শাস্ত্রী টিভিতে বলল, ওরা নাকি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা টিমগুলোর মধ্যে পড়ে। ভেবে বলল কী বলছে? যে কোনও ক্রিকেটবিশ্লেষক মন যা বলবে এর পর অনিবার্যভাবে তিনিও তাই বলতেন-আইসিসি ট্রফি কোথায় তোমার যে সেরাদের মধ্যে পড়বে? সর্বকাল তো বাদ-ই দিলাম।

স্ট্যাট দেখছিলাম যে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জয়সমেত ৭৬ ওয়ানডে ম্যাচে ৫১ জিতেছেন কোহলি-শাস্ত্রী। টি টোয়েন্টিতে আজকের নামিবিয়া বাদ দিয়ে ৬৪ ম্যাচে জয় ৪২। দেখতে যত ঝকঝকে হোক একটু স্ক্যান করলেই দেখা যাবে আসল বস্তুটাই নেই। যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ডালমিয়া এতটুকু অনুরাগী ছিলেন না এই রেকর্ড সেই অস্তগামী সূর্য। দিনের আলো কোথায় ? যার ডাক নাম আইসিসি সাফল্য? ২০১৪ এশিয়া কাপে হার। ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হার। ২০১৬ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হার। তিনটিতেই নেতা কোহলি নন। কম্বিনেশন শাস্ত্রী- ধোনি। কিন্তু এরপর ২০১৯ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে থেমে যাওয়া। ২০২১-র বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায় থেকে বিদায়। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে উড়ে যাওয়া। সবে তো এই জুটি। তার মানে দ্বিপাক্ষিকের রাজা। আইসিসি টুর্নামেন্ট এলেই প্রজা।

তা হলে আর রাজত্বের ঠাঁটবাট কোথায়? বিশ্বক্রিকেটের বাণিজ্যে ম্যাডিসন স্কোয়ার এভিনিউয়ের মতো অনন্ত প্রতাপশালী এবং সবরকম ক্রিকেটীয় সুযোগসুবিধেতে পয়মন্ত দেশ যদি সাত বছর আইসিসির ট্রফি ক্যাবিনেটে না তুলতে পারে তাহলে তাঁর সর্বোচ্চ ক্রিকেট কর্তা খুশি হতে যাবেন কোন দুঃখে? তা তিনি জীবিত হন বা মৃত! শাস্ত্রী একটা কথা বলেছেন যে কী অর্জন করতে পারিনি তার চেয়েও দেখা উচিত, কোথা থেকে পর্যটন করে এসেছি? তিনি এবং কোহলি মিলে ভারতীয় ক্রিকেটে যে আদ্যন্ত নতুন ধারার ফিটনেস নির্ভর টিমের জন্ম দিয়েছেন এপর্যন্ত কোনও বিতর্ক নেই। তা বলে এরা অসমসাহসী কোথায় ? নামিবিয়া আর স্কটল্যান্ডের সঙ্গে যে অসমসাহস ব্যাটসম্যানরা দেখিয়েছেন তা কোথায় ছিল প্রথম দু’দিন ? কোথায় ছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ড সেমি ফাইনালের দ্বিতীয় দিন ? কোথায় ছিল সাউদাম্পটন ফাইনালে? অসমসাহস থাকলে তো ব্যাটিং এভাবে চাপের মুখে চোক করত না। 

আর সাত বছর ধরে তো এক ইতিহাস। পৃথিবীর কোনও কোচ-ক্যাপ্টেন বলতে পারে না যে সাত বছর ধরে আমরা পর্যটন করছি। বায়ো বাবলের জন্য এমন হাল এটাও হাস্যকর। দুটো ওয়ার্ম আপে দুই সেমি ফাইনালিস্টকে উড়িয়ে দিতে বায়ো বাবল সমস্যা করল না। শেষ তিন ম্যাচে করল না। শুধু ওই দুটো দিনই বায়ো বাবল ভোগাল বুঝি? বিরাট কোহলি সাদা বলের ক্রিকেটে হয়তো ভারতের সর্বকালের সেরা। কিন্তু আগামী দিনে নানান প্রশ্নে তাঁর সময়কাল আক্রান্ত হবেই। কেন দল নির্বাচন নিয়ে নিরন্তর বিতর্ক লেগে থাকত যা অতীতের গুরু গ্রেগের সময়েও এই পর্যায়ে হয়নি। বিশ্বাস করতে রাজি নই শাস্ত্রীয় ক্রিকেট মগজ এত ভুল এতবার করবে। কিন্তু তিনি ক্যাপ্টেনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সবসময়। বিশেষ করে রবিচন্দ্রন অশ্বিন (Ravichandran Ashwin) ইস্যুতে। অশ্বিন ইস্যুতে জ্বলতে থাকা আগুন যে এই টুর্নামেন্টেও ভারতের কত ক্ষতি করে দিয়েছিল, একদিন নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন শাস্ত্রী। বোর্ড কর্তারা চাপ দিয়ে অশ্বিনকে সাদা বলে ফিরিয়েছিলেন এবং তিনি শেষদিন ৩-২০ নিয়ে দেখিয়ে দিলেন চার বছর তাঁকে বসিয়ে রাখা কত অন্যায্য ছিল। এই জুটির ফেয়ারওয়ালে যেন বিদায়ী উপহার হয়ে থাকল আজ অশ্বিনের স্পিনিং বাতাস।

শাস্ত্রী-কোহলি (Ravi Shastri, Virat Kohli) নিয়ে আবেগ তো হওয়ারই কথা। শতকরা ৬৪ শতাংশ জেতার রেকর্ড। কিন্তু আতঙ্ক লাগে তার বুদবুদে যেন কঠিন প্রশ্নগুলো চাপা না পড়ে যায়। আজকাল চট করে ভারতীয় ক্রিকেট মিডিয়াতে কেউ প্রভাবশালীদের বিপক্ষে বলতে/ লিখতে চায় না। কে দেখবে? কে বাঁচাবে এঁদের পাল্টা আক্রমণে? সুখের কথা যা বলার সাত বছরের স্কোরবোর্ডেই বলা রয়েছে। সেই সমুদ্রমন্থন মনে হয় দ্রাবিড়ের ভালোই করবে। আর অস্তগামী নয়-উদিত সূর্য দেখবে ভারতীয় ক্রিকেট। 

[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপই হারানো সম্মান ফিরিয়ে দিল বাবরদের! ২৪ বছর পর পাক সফরে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement