যুদ্ধ, পরকীয়া, রাজনীতি, চিনা দ্রব্য – ভাবিয়ে তুলছে আপনাকে নাকি সামিল করছে কোনও প্রোপাগান্ডায়? আপনারই অজান্তে? উত্তর খুঁজলেন উর্মি খাসনবিশ৷
ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে
মানুষ ছিলো নরম, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারতো।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই বিখ্যাত উক্তি আচমকা উল্লেখের মাধ্যমে মানুষকে কেটে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনও অঙ্গীকার যে নেই তা শুরুতেই জানিয়ে রাখার প্রয়োজন মনে করি৷ আসলে অসহিষ্ণুতার কঠিন পরিস্থিতিতে ঠিক কোন কথা থেকে কী ঘটতে পারে, সে বিষয়ে নিজেই যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছি৷ তবে মানুষ যে নরম সে কথায় কবির সঙ্গে ভীষণভাবে একমত৷ মানুষ এখন ভীষণ নরম৷ ঠিক যেন নরম মাটির দলা৷ যেমন ইচ্ছে গড়ে পিটে নেওয়া যায় তাঁদের৷
সব মানুষ নরম? নরম মাটির দলার মতো তো শিশুরা হয়, তাদের মনের মতো করে বড় করে তোলা যায়, আপনার মনে এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে৷ নিজেও হয়তো কয়েকবছর আগে এমন কথা শুনলে প্রতিবাদ করতাম৷ কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে৷ এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি, মানুষ সত্যিই খুব নরম৷ কেটে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিলেও তাঁদের বুদ্ধি এবং ভাবনাকে নিয়ে যথেচ্ছ খেলাধুলা করতে পারা যায়৷ কেন পারা যায়? বলা উচিত, মানুষের ভাবনাচিন্তা নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলাধুলা করছে একটা সিস্টেম৷ আর মানুষ এতই নরম যে বিবেচনা করার ক্ষমতা হারিয়েছে ঠিক কীভাবে প্রতিদিন ভিন্ন সিস্টেমের তৈরি ভিন্ন প্রোপাগান্ডার অংশীদার হচ্ছেন বিনা কোনও ভাবনায়, বিনা কোনও চিন্তায়৷
কেন হঠাৎ গোটা বিশ্বে এত ইস্যু, এত ঘটনা থাকতে আম আদমিকে নিয়ে পরলাম? সাম্প্রতিক কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করলে মনে করি ব্যাপারটি আপনাদের কাছে স্পষ্ট হবে৷ এই ধরুন দীপাবলি আসছে৷ ছোটবেলায় দেখে এসেছি জেঠিমা গোটা বাড়ি দীপাবলির দিনে প্রদীপ দিয়ে সাজাতেন৷ যোগ্য সঙ্গত করত মোমবাতি৷ প্রদীপের হলদে আলোগুলো যে আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরি করত তা আশ্চর্যভাবে মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে৷ কিন্তু সময় পাল্টেছে৷ প্রদীপ কিংবা মোমবাতির পরিবর্তে এসে গিয়েছে টুনি লাইট৷ বাজার ভরে গিয়েছে চিনা আলোয়৷ রংবেরঙের রোশনাইয়ে হারিয়ে যেতে বসেছিল প্রদীপের হলদে আলো৷ কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছিল বললে এক্ষেত্রে খানিক ভুল বলা হবে বলে মনে করি৷ আমার আপনার মতো মানুষ রীতিমতো প্রদীপের আলোকে ত্যাগ করে চিনা আলোয় মজেছিলাম৷ সেই চিনা আলোতে কী করে মজেছিলেন, কেন হঠাৎ প্রদীপকে বিদায় জানালেন সেসব ভেবে দেখার দায়িত্ব আপনার৷
কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে দেখছি, সেই প্রদীপের উপরই ভরসা ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছেন আম আদমি৷ হঠাৎ এত প্রদীপপ্রীতি যে এমনি এমনি আসেনি, তা বলাই বাহুল্য৷ চিনা দ্রব্য বর্জন করার ইচ্ছেতে ভর করে শুরু হয়েছে এই হলদে আলোদের ফিরিয়ে আনার অভিযান৷ প্রতিবেদনে পড়ে জানতে পারলাম এই বছর নাকি প্রদীপের চাহিদা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশ অনেকটা বেশি৷ আচমকা প্রদীপের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য এখন নাকি দম ফেলার ফুরসত মিলছে না শিল্পীদের৷ চিনা আলো বয়কট করার জন্যই নাকি এই উদ্যোগ৷ মানুষের মধ্যে প্রদীপের প্রতি যে ভালবাসা বেড়ে গিয়েছে তা দেখে ভাল লেগেছে নিঃসন্দেহে৷ তবে অবাক হয়েছি তার থেকেও বেশি৷ যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হল, কাল যদি চিনের মতো ঝকমকি আলো নিয়ে চিনের পরিবর্তে জাপান বা কোরিয়া এসে হাজির হয়, তবে আবার প্রদীপকে বর্জন করবেন কি?
দেশীয় শিল্প, দেশীয় কাজকে অবহেলা করা মনে হয় যে কোনও মানুষেরই সহজাত প্রবৃত্তি৷ আর তা থেকেই মনে হয় এতদিন পর্যন্ত প্রদীপ তৈরির মতো কুটিরশিল্পকে নির্দ্বিধায় অবহেলা করে এসেছি আমি বা আপনি৷ কিন্তু আজ আচমকা চিনা দ্রব্য বর্জনের এজেন্ডার কথা মাথায় রেখে ভিড় করে ফিরেছি প্রদীপ দিয়ে ঘর আলো করতে৷ এখনও বিশ্বাস করেন, আপনি নরম নন? আপনার ভাবনা অন্য কেউ চালাতে পারেনা?
অপর একটি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে কথা বললে মনে হয় বিষয়টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করতে পারব৷ সেই স্পর্শকাতর বিষয়টি হল ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক৷ ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই দুই দেশের সম্পর্ক যে কোনও কালেই চরম বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না তা বোধহয় বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখেনা৷ ভারত বহু সহিষ্ণুতার নিদর্শন দেখিয়ে যুদ্ধ এবং শত্রুতা ঠেকিয়ে রেখেছে একথাও সত্যি৷ কিন্তু আচমকা চলতি বছরে এই যুদ্ধ-যুদ্ধ রবে আশেপাশে কান পাতা দায়৷ এত দেশভক্তি, প্রতিবেশী দেশকে এত ঘৃণা, পাকশিল্পীদের এত ঘৃণা – এই ঘটনাগুলি কিন্তু নিজের চোখে গত কয়েক বছরে দেখেছি বলে মনে করতে পারিনা৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট, গ্লোবালাইজেশনের যুগে সবকিছু নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয় তা কিছুটা হলেও সত্যি৷ কিন্তু তা বাদ দিয়েও এই যুদ্ধ-যুদ্ধ রবটা যে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না?
এবার একটা কথা ভেবে দেখুন, পাকিস্তানের কতজন সাধারণ মানুষকে আপনি চেনেন? সেদেশের হিন্দু অথবা মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে কতটা অবগত? তাঁরা আদৌ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চায় কিনা সেই সম্পর্কে কোনও ধারণা রয়েছে কি? আচ্ছা পাকিস্তানের কথা ছেড়ে দিন না হয়৷ আপনি নিজে যুদ্ধ চান কী না চান সে বিষয়টি সিস্টেমের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কি? সেটা একটু ভেবে দেখুন তো৷ আপনি একটি সিস্টেমের অংশ হিসাবে রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের মতামত কতটা চাপিয়ে দিতে পারেন তাও মনে হয় যাচাই করে দেখার সময় এসেছে৷
গোটা বিষয়টি নিয়ে একটু তলিয়ে ভাবলে যা বুঝবেন সেটি হল, আপনি কী ভাবছেন সেটা কিন্তু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ বৃহত্তর ক্ষেত্রে তা বিশেষ কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে৷ তাই আপনি যখন কোনও সিস্টেমের কোথায় সায় দিচ্ছেন, তা কেন দিচ্ছেন, কোন ভাবনাকে কেন্দ্র করে মতামত তৈরি করছেন তা মনে হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে৷ নিজের অজান্তে আপনি কোনও প্রোপাগান্ডার অংশীদার হয়ে পড়ছেন কিনা তাও বুঝে দেখার সময় এসে গিয়েছে৷ কোনও শিল্পীকে এবং তাঁর শিল্প সত্ত্বাকে আপনি ঘৃণা করছেন না তাঁর পাকিস্তানি হওয়ার কারণকে ঘৃণা করছেন তা বুঝে দেখাও এখন জরুরি৷ অহেতুক ঘৃণা আপনার সহজাত না আপনি কোনও প্রোপাগান্ডার অংশীদার তাও বুঝে দেখার সময় এটা৷
কেবল পাকিস্তান বা চিন নয়, জীবনে চলার পথে প্রায় প্রতি ছোট-বড় ক্ষেত্রে এমনই প্রোপাগান্ডার সম্মুখীন হই আমরা৷ ছাত্র রাজনীতি হোক বা পরকীয়া, কখন অন্যের ভাবনা নিজেদের ভাবনাগুলোকে খুব ধীর পদক্ষেপে গ্রাস করে তা হয়তো নিজেরাই বুঝতে পারিনা৷ তাই খুব বড় বড় ঘটনাকে নিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে নিজেদের ভাবনাচিন্তায় শান দেওয়া জরুরি৷ নইলে ভাবনাগুলি নরম হওয়ার সুবাদে ছড়িয়ে যাবে ভিন্ন প্রোপাগান্ডার অংশীদারীর কাজে৷ আর আপনি জানতেও পারবেন না৷
The post ভাবনার প্র্যাকটিস এবং প্রোপাগান্ডায় অংশীদারী appeared first on Sangbad Pratidin.