সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: গদিচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরতেই চরম অরাজকতা তৈরি হয়েছে সিরিয়ায়। এতদিন যে রাশিয়া ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল দামাস্কাসের পাশে তারাই এখন পাততাড়ি গোটাচ্ছে দেশ থেকে। নতুন করে ডঙ্কা বাজছে গৃহযুদ্ধের। মাথাচাড়া দিচ্ছে ইসলামিক স্টেটও। যা নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছে আমেরিকা! এদিকে দামাস্কাসের কাছাকাছি চলে এসেছে ইজরায়েল। হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েলি ফৌজ। ফলে আসাদহীন সিরিয়ায় মঞ্চস্থ হচ্ছে মহানাটক। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির ভবিষ্যৎই এখন বড় প্রশ্নের মুখে।
২০১১ সালে আরব বসন্তের হাওয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে সিরিয়ায়। আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে একনায়ক হঠাও, গণতন্ত্র ফেরাও স্লোগানে। শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। এই সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে চলতি বছরের নভেম্বরে। গত ২৬ তারিখ থেকে আল কায়দার শাখা সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নেতৃত্বে আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়ংকর লড়াই শুরু করে বিদ্রোহীরা। ফলে গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্র ফেরানোর যে লড়াই ছিল তা কার্যত হাইজ্যাক করে নেয় জেহাদিরা। অবশেষে ৮ ডিসেম্বর রবিবার বিদ্রোহীদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় সেনা। ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন আসাদ। এরপর থেকেই বদলে যেতে শুরু করে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক চিত্র। এবার সিরিয়া থেকে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে রাশিয়া!
সিরিয়ায় পতন আসাদ সাম্রাজ্যের।
সিএনএন সূত্রে খবর, শুক্রবার সকালে ম্যাক্সারের উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে, উত্তর সিরিয়ার অন্যতম বন্দর শহর লাতাকিয়ায় রুশ বিমানঘাঁটির তোরজোড়। সেখানে উপস্থিত রয়েছে দুই রুশ পণ্যবাহী এএন-১২৪ সামরিক বিমান। চলছে এয়ার বেসের সমস্ত সরঞ্জাম বোঝাইয়ের কাজ। এছাড়া ভেঙে ফেলা হচ্ছে একটি কেএ-৫২ হেলিকপ্টার। ইতিমধ্যেই এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স ইউনিটের কিছু অংশ, একটি রাশিয়ান সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এয়ার বেসটি ছেড়ে দিচ্ছে মস্কো। এনিয়ে ক্রেমলিন জানিয়েছে, " সিরিয়ার রুশ সামরিক ঘাঁটি ও আমাদের কূটনীতিকদের সুরক্ষাই সবার আগে। দামাস্কাসের নতুন নেতাদের সঙ্গে আগামী দিনে রাশিয়া যোগাযোগ বজায় রাখবে।"
উত্তর সিরিয়ার অন্যতম বন্দর শহর লাতাকিয়ায় রাশিয়ার দুই সামরিক বিমান।
এদিকে, আসাদ যুগের অবসান ঘটলেও নতুন করে গৃহযুদ্ধের মেঘ ঘনাচ্ছে সিরিয়ায়। একদিকে রয়েছে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) বা কুর্দবাহিনী। তাদের সাহায্য করছে আমেরিকা। অন্যদিকে তুরস্কের মদতপ্রাপ্ত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)। নেতৃত্বে তাহরির আল-শাম। আসাদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটাতে এসডিএফ ও এফএসএ দুজনেই লড়াই করছিল। কিন্তু এদের নিজেদের মধ্যেই সংঘাত চরমে। ফলে এখন আসাদ সরতেই ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস আর ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। গত কয়েকদিন ধরে মানজিব শহরে তীব্র লড়াই চলেছে দুপক্ষের মধ্যে। অবশেষে বৃহস্পতিবার চারদিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় সেখানে। কিন্তু সিরিয়ার দক্ষিণ অংশে এখনও সংঘাত জারি রয়েছে। আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তিশরিন বাঁধ নিয়েও। দুপক্ষের লড়াইয়ের জন্য যদি এই বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত তাহলে অন্তত ৪০টি গ্রাম বন্যায় তলিয়ে যাবে। যা নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে রাষ্ট্রসংঘও।
সিরিয়ার এই পরিস্থিতি ভয় ধরাচ্ছে আমেরিকার মনেও। কারণ সিরিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে রাশিয়া। এসডিএফ ও এসডিএফ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত। ফলে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো জঙ্গি সংগঠন। যাদের সঙ্গে আল শামেরও যোগাযোগ রয়েছে বলে শোনা যায়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সিরিয়ায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করতে পারে আইএস। যেখান থেকে আমেরিকা-সহ বিশ্বের নানা দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাবে জঙ্গিরা। পাশাপাশি আইএসের মদতেই মাথাচারা দিয়ে উঠবে নতুন নতুন জঙ্গি গোষ্ঠী। তাই যেকোনও মূল্যে আইএসকে রুখতে ইরাকের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে আমেরিকা। এই বাগদাদে রয়েছেন মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। সেখানকার মার্কিন দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, "দায়েশ কয়েক বছর আগে যে আঞ্চলিক খিলাফত তৈরি করেছিল তা ঘুচিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু দায়েশ আবার মাথাচারা দিচ্ছে। আমরা এটা হতে দিতে পারি না।” প্রসঙ্গত, আইএস অপর নাম দায়েশ।
ইরাকে সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছেন মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
অন্যদিকে, সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েল। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে হচ্ছে একের পর এক সেনাঘাঁটি, অস্ত্রভাণ্ডার। প্রথম থেকেই সিরিয়ার গোটা পরিস্থিতির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল ইজরায়েল। বিবৃতি দিয়ে আইডিএফ দাবি করে, সিরিয়ার সামরিক পরিকাঠামোগুলোকে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়াই ইজরায়েলের উদ্দেশ্য। কারণ সেখান থেকে কার্যকলাপ চালাচ্ছে ইরানের সেনা। সিরিয়ার অস্ত্র কারখানায় তৈরি হাতিয়ারগুলোকে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে ইরানের মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো।
যদিও সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করে তেহরান জানিয়ে দিয়েছে, সিরিয়ায় এখন কোনও ইরানি সেনা মোতায়েন নেই। কিন্তু কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ইজরায়েল। তাই যাতে জঙ্গিদের হাতে সহজে নানা হাতিয়ার না পৌঁছয় তাই সমস্ত অস্ত্র কারখানা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ময়াদানে নেমেছে ইজরায়েলি সেনা। যাতে পড়শি দেশ থেকে কোনও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইজরায়েলের বুকে না হয়। ফলে সব মিলিয়ে সিরিয়ায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতির বড় নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশের পরিস্থিতি আগামী দিনে বিশ্ব মানচিত্রে কী প্রভাব ফেলে সেদিকেই নজর থাকবে আন্তর্জাতিক মহলের।