নব্যেন্দু হাজরা: হলুদ ট্যাক্সি। গত কয়েক দশক ধরেই কলকাতার চেনা এক আইকন। শহরের পথঘাটে এই যানটির গতিবিধি যে কলকাতার স্পন্দন হয়ে উঠেছে বহুদিন ধরে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। হারিয়ে যেতে যেতেও এখনও টিকে রয়েছে ট্রাম। কিন্তু হলুদ ট্যাক্সি কি হারিয়ে যাবে? দিনে দিনে কমে যাচ্ছে এই ট্যাক্সির সংখ্যা। ফলে দৌরাত্ম্য কমে গিয়েছে অনেকটাই। ফলে একটা সময় কি আসবে যখন আর দেখাই মিলবে না এই ট্যাক্সির? প্রশ্নটা সহজ হতে পারে, উত্তর এখনও জানা নেই। কিন্তু সংশয় ক্রমেই বাড়ছে।
জানা যাচ্ছে, কোভিড শুরুর আগে এই শহরে হলুদ ট্যাক্সি চলত প্রায় আঠেরো হাজার। আজ তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজারে! আসলে লকডাউনের ধাক্কায় বহু ট্যাক্সির মালিকই গাড়ি বেচে দিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গিয়েছেন। পাশাপাশি ১৫ বছরের অনেক বেশিই বয়স হয়ে গিয়েছে অধিকাংশ গাড়ির। ফলে ক্রমেই একের পর এক বসে যাচ্ছে অ্যাম্বাসাডর। আর ওই কোম্পানিও নতুন করে গাড়ি তৈরি করছে না। এই বছরের শেষে একলাফে বসে যাবে প্রায় সাড়ে চার হাজার হলুদ ট্যাক্সি! যা থেকে স্পষ্ট, সিঁদুরে মেঘ কিন্তু আরও ঘন লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
স্বাধীনতা লাভের অনেক আগে থেকেই এই শহরের রাজপথে দাপিয়ে বেড়াত ট্যাক্সি। ইতিহাস বলছে, ১৯০৮ সালে কলকাতায় শুরু হয় পরিষেবা। তখন ভাড়া ছিল মাইল প্রতি আট আনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ১৯৪৮ সালে উত্তরপাড়ার হিন্দুস্তান মোটর ফ্যাক্টরিতে শুরু হয় গাড়ি তৈরি। ১৯৫৮ সাল থেকে সেখানে তৈরি হতে থাকে অ্যাম্বাসাডর। ১৯৫৬ সালের মরিস অক্সফোর্ড সিরিজ ৩-কে মাথায় রেখেই তৈরি হয় নকশা। এর পর ১৯৬২ সালে কলকাতা ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন অ্যাম্বাসাডরকেই পরিণত করল ট্যাক্সিতে। রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয় হলুদকেই। কারণ একটাই, দূর থেকে পরিষ্কার দেখা যায় এই রং। এমনকী, রাতের বেলাতেও!
সেই শুরু। গত ছয় দশকে অনেকটা বদলে গিয়েছে শহর। ফ্লাইওভারের পর ফ্লাইওভারে গিঁট লেগেছে রাজপথের শরীরে। মেট্রোর সম্প্রসারণ হয়ে চলেছে দ্রুত। কিন্তু আজও কলকাতার রাজপথে হলুদ ট্যাক্সির আবেদন এতটুকু বদলায়নি। অ্যাপ ক্যাব এসেছে। হলুদ ট্যাক্সির চালকদের দুর্ব্যহার, গরমে গাড়ির ভিতর তেতে ওঠার মতো কারণে অনেকেই সেদিকে ঝুঁকেছে। তবু হলুদ ট্যাক্সি রয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার ক্রমহ্রাসমান হয়ে পড়ায় সংশয় বাড়ছে। আর কদ্দিন তাহলে চলবে হলুদ ট্যাক্সি?
সম্প্রতি হলুদ ট্যাক্সিকে বাঁচাতে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীকে চিঠি লিখেছেন ট্যাক্সি চালকরা। পনেরো বছরের নিয়ম মেনে এই ট্যাক্সি বসে গেলেও তাঁদের দাবি, ওই পারমিটে নতুন গাড়ি নামাতে দেওয়া হোক। তার রংও হোক হলুদ। সংগঠনের আহ্বায়ক নওয়ালকিশোর শ্রীবাস্তব বলেছেন, “হলুদ ট্যাক্সির সঙ্গে কলকাতার নস্ট্যালজিয়া জড়িয়ে রয়েছে। ফলে এটাকে উঠিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।''
ট্রাম প্রায় উঠেই গিয়েছে। যদিও খাতায় কলমে শেষ ট্রাম মুছে যায়নি আজও। কিন্তু গভীর রাত অথবা ভন্যি দুপুরে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে হাজির হয়ে যাওয়া হলুদ ট্যাক্সিকে ঘিরে জমছে অনিশ্চয়তার কুয়াশা। সংখ্যায় কমলেও সে যেন টিকে থাকে শহরের রাজপথে- আপাতত এটাই প্রার্থনা নস্ট্যালজিয়ায় আচ্ছন্ন এই শহরের বহু মানুষের।