সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: গণতান্ত্রিক দেশে ভোট মানেই এক বড়সড় উৎসব। আর তাতে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কোমর বেঁধে নেমে পড়বেন, সেটাই পরিচিত চিত্র। অভিজ্ঞরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন, অনুগামীরা ময়দানে নেমে কাজ করবেন, পরিকল্পনা রূপায়ণ করবেন। কিন্তু কোথাও কোথাও যখন এই 'গাইডেন্স'-এর অভাব ঘটে, তখনই দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন কর্মীরা। হয়ত বিকল্প কোনও নেতার খোঁজ করেন তাঁরা। চব্বিশের লোকসভা ভোটে বাংলায় খানিকটা তার ছায়া পড়ছে। রাজ্যের শাসকদলের তিন দুঁদে নেতা - অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal), পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এখন জেলবন্দি। এবার তাঁদের ছাড়াই বীরভূম, কলকাতা দক্ষিণ, বারাসতের একাংশে তৃণমূল কর্মীরা লড়বেন লোকসভার লড়াই। কোথাও কি কিছুর অভাব বোধ হচ্ছে? নাকি এক্ষেত্রে ব্যক্তি 'গাইড' নন, দলীয় সংগঠনের তৈরি গাইডবুকেই দিব্যি পেরিয়ে যাওয়া যাবে ভোট বৈতরণী? তারই সুলুকসন্ধান করল 'সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল'।
বীরভূমে (Birbhum) ঘাসফুল শিবির মানেই কেষ্ট মণ্ডলের নেতৃত্ব। বাম আমলে শাসকের 'অত্যাচার' সহ্য করে বিরোধী জায়গা থেকে সংগঠন তৈরি করা থেকে পরবর্তীতে তা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো - একাহাতেই কাজ করেছেন অনুব্রত মণ্ডল। যে কারণে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় চোখ বন্ধ করে তাঁকে ভরসা করেন। রাজ্যে বামশাসন শেষের পর রাঢ়বঙ্গের এই অঞ্চলের রাজনীতি এতদিন ছিল অনুব্রত মণ্ডলের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক কিছু কম নেই। 'গুড়বাতাসা', 'চড়াম চড়াম' - অনুব্রতর মুখ থেকে নির্গত এসব শব্দবন্ধ প্রায় মিথের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। নিন্দুকরা এনিয়ে যতই সমালোচনা করুন, রাজনীতিতে সামান্য অভিজ্ঞতা থাকলেই বোঝা যায়, এসবই আসলে ভোটের সময় অনুব্রতর 'স্টান্ট' ছিল। মূল উদ্দেশ্য, তৃণমূলের পক্ষে জনসমর্থন টেনে রাখা। এলাকায় দাপুটে এবং পরোপকারী - পরস্পরবিরোধী দুই ইমেজই ছিল অনুব্রতর।
সিবিআইয়ের হাত গ্রেপ্তার অনুব্রত মণ্ডল। ফাইল ছবি।
এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সিবিআইয়ের (CBI) হাতে গ্রেপ্তার হন গরু পাচার মামলায়। এখন তিনি দিল্লির তিহার জেলে বন্দি। স্রেফ 'প্রভাবশালী' তকমায় বার বার অনুব্রত মণ্ডলের জামিনের আবেদন খারিজ হয়। বোলপুরের নিচুপট্টিতে একসময়ে গমগম করা তাঁর বাড়ি এখন শুনশান, তালাবন্ধ। বীরভূম জেলায় প্রথম কোনও বড় ভোটে কেষ্ট মণ্ডলের শূন্যতা জেলা তৃণমূলের অন্দরে। কিন্তু 'রাঙা মাটির দেশে' কেষ্ট মণ্ডলের প্রভাবই বলুন বা জনপ্রিয়তা, এত বেশি যে সশরীরে না থেকেও জেলা নির্বাচনী ময়দানে খেলোয়াড় তো তিনিই! দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা স্লোগানে অনুব্রতর নাম, তাঁর বাঁধা লব্জ।
বীরভূমের তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়ের অনুব্রতর নামে দেওয়াল লিখন। নিজস্ব চিত্র।
অনুব্রত গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৫ জনের কোর কমিটি গড়ে বীরভূমের দলীয় সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার নেতৃত্বেই লোকসভার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তৃণমূল। সেই কমিটির আহ্বায়ক তথা সিউড়ির বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী বলছেন, ''জেলা সভাপতি আমাদের মধ্যে আছেন। তাঁর দেখানো পথেই ভোট হবে। অনুব্রত মণ্ডল বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেসের অভিভাবক। তিনি আমাদের অনুভূতিতে রয়েছেন। হৃদয়ে রয়েছেন। তাঁরই তৈরি সংগঠন জেলায় কাজ করছে।'' আর বিরোধীদের দাবি, তৃণমূল দুর্নীতির সরকার। চাকরি চুরি থেকে শুরু করে গরু পাচার, কয়লা পাচার - দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মানুষ এর জবাব দেবে। এবার কেষ্টর বিরুদ্ধেই ভোট হবে।
[আরও পড়ুন: বাংলায় এসেই শক্তিপীঠে রণিত রায়, কোথায় পুজো দিলেন?]
কলকাতার ভোট রাজনীতির আরেক ব্যক্তিত্ব, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও (Partha Chatterjee) এবার অনুপস্থিত। বেহালা পশ্চিমের তৃণমূল বিধায়ক পার্থবাবু বহুদিনের রাজনীতিক। ভোটের প্রচারে বা সংগঠনের কাজে তাঁর অভিজ্ঞতায় নির্ভর করতেন স্বয়ং দলনেত্রীও। শিক্ষা দুর্নীতি মামলায় প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি জেলবন্দি। দলের তরফেও সমস্ত পদ কাড়া হয়েছে। তাতে কি ভোটের কাজে কোনও প্রভাব পড়বে? অরুণ মণ্ডল নামে এক ব্লক নেতার দাবি, তাঁর অনুপস্থিতি কোনও সমস্যাই নয়। লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগে থেকে এই এলাকা দেখার জন্য আলাদা কমিটি গড়ে দিয়েছে রাজ্য নেতৃত্বে। জেলা সভাপতি দেবাশিস কুমারের নেতৃত্বে সেই কমিটিই স্থানীয় সমস্যা থেকে ভোট, সবটা নজরে রেখেছে। আর পাশের কেন্দ্র বেহালা পূর্বের বিধায়ক রত্না চট্টোপাধ্যায় নিজে সংগঠন ও প্রচারের বিষয়টি দেখছেন। প্রার্থী মালা রায় নিজে বিশেষ দায়িত্বে আছেন। সর্বোপরি রয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। ভোট থেকে জয়, সবটাই হবে মসৃণভাবে।
জেলের পথে পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়। ফাইল ছবি।
হাবড়ার (Habra) তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের আরেক প্রাক্তন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু রেশন দুর্নীতি মামলায় সদ্য গ্রেপ্তার হয়ে জেলে। এই এলাকার সংগঠনের অনেকটাই তাঁর হাতে তৈরি। ফলে নির্বাচনের সময়ে তাঁর অনুপস্থিতির একটা প্রভাব থাকবে বলে ধারণা অনেকের। কিন্তু এখানে বাস্তব সামান্য ভিন্ন। হাবড়া পুরসভার চেয়ারম্যান নারায়ণচন্দ্র সাহা বললেন, ''আমাদের হাবড়া বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য একটা ৮ সদস্যের কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে আমি আছি, যুগ্ম আহ্বায়ক, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, প্রাক্তন বিধায়ক, যুব নেতা, টিএমসিপি নেতা সকলেই আছেন। আমরা লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। হাবড়া থেকে এবার আরও ভালো ফল করব।''
জেলবন্দি প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ফাইল ছবি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে জ্যোতিপ্রিয়র (Jyotipriya Mallick) কেন্দ্র হাবড়া থেকে প্রায় ২০ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিলেন তৃণমূল (TMC) প্রার্থী। তবে পরবর্তী বিধানসভা ও পঞ্চায়েত ভোটে সেই ব্যবধান অনেকটাই ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম হয় তৃণমূল। চব্বিশের লক্ষ্য আরও বেশি ভোটে এগিয়ে থাকা। যদিও জেলার অন্দরে সকলেই জানেন, লোকসভা ভোটে বারাসতের বিদায়ী সাংসদ তথা তৃণমূল প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার নিজেই সমস্ত প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন। বিধায়কদের বিশেষ দায়িত্ব দেন না। ফলে জ্যোতিপ্রিয়র ময়দানে থাকা কিংবা জেলে থাকার মধ্যে তেমন তফাৎ থাকছে না। কিন্তু ভোটের বাংলায় আমজনতার মনে মনে বার বারই ফিরে ফিরে আসবে কেষ্ট, পার্থ, বালুর মুখ, তা নিশ্চিত করে বলাই যায়।