উন্নয়নের চেহারা কি কেবলই বাহ্যিক? বৈষম্য ও দারিদ্র ক্রমবর্ধমান হওয়ার যে খতিয়ান সামনে আসছে, তাতে এই প্রশ্ন প্রতীয়মান হচ্ছেই।
১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এরপর, ১৯৩০ সালে তিনি গেলেন রাশিয়া ভ্রমণে। সেখানে সমবায় প্রথায় চাষাবাদ দেখে শ্রীনিকেতনের আদর্শবাহী ভাবনাগুলি যেন আরও উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত রূপ পেল। সেই প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছিলেন, ‘কৃত্রিম উপায়ে ধন বণ্টন করে কোনও উন্নতি হয় না। জনসাধারণ যদি তাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে একত্রে মেলাবার উদ্যোগ করে, তবেই কেবলমাত্র আর্থিক সাম্য ও স্বাধীনতা আসবে।’
বর্তমানে বিশ্বে আর্থিক অসাম্য ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, এবং বৈষম্যরেখা হয়ে উঠছে স্পষ্ট। যার থেকে বিচ্ছিন্ন নয় ভারতও। ‘পভার্টি, প্রসপ্যারিটি অ্যান্ড প্ল্যানেট: পাথওয়েজ আউট অফ পলিক্রাইসিস’ শীর্ষক রিপোর্টে বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, বর্তমানে ভারতে ১২.৯ কোটি মানুষ চরম দারিদ্রের মধ্যে বাস করছে– যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯.২ শতাংশ! অর্থাৎ, তাদের আয় দৈনিক ১৮১ টাকারও কম। অথচ, ২০২৭-এর মধ্যে নাকি জাপান ও জার্মানিকে টপকে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে চলেছে! ২০৪৭-এর মধ্যে ভারত নাকি ‘উন্নত’ দেশ হয়ে যাবে বলে লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। আর বাস্তবচিত্র বলছে, যে-কৃত্রিম উন্নতির কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সে-পথেই হঁাটছে দেশ।
সুউচ্চ অট্টালিকা, ঝঁা-চকচকে রাস্তা, সেতু থেকে শুরু করে উপনগরী– উন্নয়ন হচ্ছে বাহ্যিক। প্রকৃত উন্নয়ন অধরাই। উন্নয়নকে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে যে বিষয়গুলির উপর নজর রাখা দরকার সেগুলি হল– দারিদ্র দূরীকরণ, আয় বণ্টনের সমতা, বেকারত্ব দূরীকরণ বা কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, সম্পদের সমবণ্টন এবং মোট জাতীয় উৎপাদন বা ‘জিডিপি’ বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক বৃদ্ধি (ইকোনমিক গ্রোথ) এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন (ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট) কিন্তু এক নয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে লিঙ্গসাম্য, সাক্ষরতার হার, সুষম খাদ্য ইত্যাদি অনেক মাপকাঠি থাকে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক স্বীকার করেছে, দারিদ্র দূরীকরণের গতি শ্লথ হতে হতে একজায়গায় আটকে গিয়েছে।
অন্যদিকে, গত তিন দশকে ভারতে অসাম্য চরমে। ধনীরা আরও দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়াচ্ছে। মোট জাতীয় সম্পদের ৭৭ শতাংশ রয়েছে দেশের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে। তার মধ্যে এখন দেশের মোট আয়ের ২২.৬% এবং মোট সম্পদের ৪০.১% পুঞ্জীভূত শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে। অন্যদিকে, ন্যূনতম মজুরি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে হয়রান হতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। কর্মসংস্থানের হারও তথৈবচ। বিশেষত, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। তার উপর জনসংখ্যার চাপও দেশের পক্ষে বিরাট চিন্তার কারণ। অথচ বাস্তব সমস্যা দূর করার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার তথ্য গোপন এবং প্রচারের ঢক্কানিনাদে দেশীয় অর্থনীতির উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরতে ব্যস্ত। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে দেশের উন্নতির অহং করা কাজের কথা নয়।