সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: উত্তর-পূর্ব চিরকালই উপেক্ষিত! অসম হোক বা মণিপুর, মিজোরাম হোক কিংবা নাগাল্যান্ড, অথবা অরুণাচলের বাসিন্দারা অভিমান করে একথা বলে থাকেন। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, আমরা তো পড়িনি স্বাধীনতা আন্দোলনে অসমের বৈষ্ণব সন্ত শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের অবদান। নাম পাইনি কনকলতার, রানি গাইদিনলিউ, রাজা টিকেন্দ্রজিতের। অথচ অসম যখন প্রায় পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়ছে, গোপীনাথ বরদলৈরা বুদ্ধি করে তা ঠেকান। সেই কাহিনিও ভারতের সব্বাইকে বলা হয়নি। মইরাংয়ে স্বাধীন ভারতের প্রথম পতাকা তুললেন নেতাজি, শেষ জনসভা করলেন নাগাল্যান্ডের গ্রামে। সেকথাও জানে অল্প লোকে। এই অবহেলাকে সঙ্গী করেই ৭৮ বছর বয়স হল ভারতের স্বাধীনতার।
অবহেলার আসলে কিছুই বলা হয়নি। মাতঙ্গিনী হাজরার পাশাপাশি কনকলতা, ভোগেশ্বরীর কথা ‘মেনস্ট্রিম ভারত’-এর ইতিহাস বইয়ে পাওয়াই যায় না। ঝাঁসির রানিকে নিয়ে বই, সিনেমা, সিরিয়ালের কত, কিন্তু টেঙফাখরি তেহসিলদারের নাম কেউ জানে না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসমের নবীনচন্দ্র বরদলৈ, চন্দ্রনাথ শর্মা, হেমচন্দ্র বরুয়া, তরুণরাম ফুকন, প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর নাম অন্তত অসমবাসী জানেন। কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাকি উত্তর-পূর্ব কতটা জড়িত ছিল, কারা অস্ত্র ধরেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে—হায় তার ইতিহাস খোদ অসমের মানুষও ভুলতে বসেছেন।
[আরও পড়ুন: রক্তাক্ত কাশ্মীর! ডোডায় তল্লাশি অভিযানে সেনা-জঙ্গি গুলির লড়াই, শহিদ সেনা আধিকারিক]
ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সংগঠিত মহিলা বিদ্রোহ কোথায় হয়েছিল? ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ কোথায় হয়? মণিপুরে কৃষিভিত্তিক সমাজে মহিলাদের ভূমিকা চিরকাল অগ্রণী। ১৯০৪ সালে ইংরেজদের বসিয়ে দেওয়া রাজা চূড়াচাঁদ সিং ও ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক শ্রম আইনের বিরুদ্ধে ‘নুপি লান’ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মণিপুরের মহিলারা। এই আন্দোলনেরই দ্বিতীয় পর্যায় সংঘঠিত হয় ১৯৩৯-৪০’-এ। ইংরেজরা রাজ্যের চাল বাইরে পাঠাত। এদিকে মণিপুরের বাসিন্দারা খেতে পেত না। এই নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন নিরস্ত্র মহিলারা। তাঁদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র ব্রিটিশ বাহিনী। মারা যান বহু নারী। এর পরেও আন্দোলন কিন্তু থামেনি। চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত।
আরও পুরনো ইতিহাস। ১৮৯১ সাল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন মণিপুরের রাজা টিকেন্দ্রজিৎ সিং। সিরাজের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও ষড়য়ন্ত্র হয়েছিল। তথাপি কাংলা প্রাসাদের মাঠে মণিপুরি সেনার প্রবল প্রতিরোধে পিছোতে বাধ্য হয় ইংরেজ সেনা। পরে ব্রিটিশ সেনা সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতি আক্রমণ করলে পর্যুদস্তু হন টিকেন্দ্রজিৎ। প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় টিকেন্দ্রজিৎ ও তাঁর সেনাপতিকে। একই ভাবে মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ে লড়েছিলেন গোষ্ঠীপতি ইউ টিরট সিং। কামান-বন্দুকধারী বাহিনীর সঙ্গে তির-ধনুক, তলোয়ার, বর্শাধারী জনজাতি সেনার লড়াই ছিল রোমহর্ষক। ঠিক যেন বাংলাদর তিতুমীর। পরে অবশ্য ইংরেজরা বন্দি করে টিরটকে। ঢাকা জেলে আমৃত্যু বন্দি ছিলেন তিনি।
[আরও পড়ুন: ‘অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে!’ আর জি কর কাণ্ডে বিস্ফোরক বিজেপি]
ইংরেজরা লুসাই পাহাড় দখল করতে এলে ১৮৯০ সালে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে প্রাণ দেন মিজোরামের বীর পাসালথা খুয়াংচেরা। মরণোত্তর ভারতরত্নে সম্মানিত করা হয়েছিল তাঁকে। এর পরেও তাঁর নাম জানেন কজন ভারতবাসী! এভাবেই এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নাম থাকা উচিত পদ্মভূষণ রংমেই নাগা জনজাতির রানি গাইদিনলিউর। অরুণাচল প্রদেশের আদি জনজাতির নেতা মাতমুর জামো ইংরেজ অপমানের জবাব দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসকও তাঁকে ছেড়ে কথা বলেনি। আন্দামানের সেলুলার জেলে মৃত্যু হয়েছিল জামোর। ভুললে চলবে না অরুণাচলে (তখন নেফা) প্রথমবার স্বাধীন ভারতের পতাকা ওড়ানো মোজে রিবাকে।
কাছাড় দখল করে ১৮৬৪-৬৬ সালের মধ্যে তার পার্বত্য অংশকে আলাদা করে উত্তর কাছাড় তৈরি করে ইংরেজরা। ইংরেজদের এই বিভাজন নীতি, জনজাতিদের উপরে আধিপত্য মেনে নেননি মাহুরের যুবক শম্ভুধন ফংলো। বহু যুদ্ধবিগ্রহের পর ব্রিটিশ সেনার হাতে প্রাণ দেন তিনি। অসম তথা দেশের প্রথম মহিলা তেহসিলদার বড়ো কন্যা টেঙফাখরির লড়াই ভোলা উচিত নয় আমাদের। ব্রিটিশ সরকারের কর্মী হয়েও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি। এভাবে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। অতএব, অবজ্ঞার প্রশ্নই ওঠে না। ৭৮তম স্বাধীনতা দিবসে স্যালুট জানাতেই হবে মাতৃভূমির বীর এবং বীরাঙ্গনাদের।