স্টাফ রিপোর্টার: “আমার বোনের হত্যার বিচার চাই।” মুসৌরির (Mussoorie) জঙ্গল থেকে উদ্ধার হওয়া একমাত্র বোনের খুলি, একটা হাত ও একটা পায়ের হাড় দেখে খুনির কঠোরতম শাস্তি ছাড়া আর কিছুই চাইছেন না অন্তরা মুখোপাধ্যায়। পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডালের বাঙালি তরুণী নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়কে খুনের পর দেহ পুড়িয়ে লোপাট করার অভিযোগে শনিবার সাহারানপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হল লিভ-ইন পার্টনারকে।
অভিযোগ, নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় নামে ওই তরুণীর সঙ্গে লিভ-ইন শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁকে খুন করেছে পার্টনার (Live In Partner) অঙ্কিত চৌধুরি (৩১)। এমনকী খুনের পরেও প্রায় মাস দেড়েক ঠান্ডা মাথায় নিবেদিতার বাড়ির লোকেদের সঙ্গে নানা গল্প করে গিয়েছে সে। শুনিয়েছে মান অভিমানের গল্প। করেছে কান্নাকাটিও। নিবেদিতার দিদি অন্তরা জানান, খুনের কথা অঙ্কিত বেমালুম শুধু চেপে যায়নি তাঁদের কাছে, এমন ভাব করেছে যেন নিবেদিতার খোঁজ না পেয়ে সে কতই কাতর। কিন্তু প্রায় মাস দু’য়েক ধরে নিবেদিতার সঙ্গে পরিবারের কেউ ফোনে কথা না বলায় সন্দেহ তীব্র হয় অন্তরা ও তাঁর বাবা-মায়ের। শুরুর দিকে নিবেদিতার ফোন থেকেই অঙ্কিত তাঁদের সঙ্গে ফোনে কথা চালিয়ে যেত। জানিয়েছিল, রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছেন নিবেদিতা। এর বেশ কিছুদিন পর ফোনে অঙ্কিতের সঙ্গে অতি কষ্টে যোগাযোগ করা হলে সে জানায়, নিবেদিতা ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছেন। এমনকী সৎকারও করে ফেলেছে সে। বিষয়টা হজম হয়নি পরিবারের। ফলে তারা ছুটে যায় দেরাদুন। তখনই প্রকাশ্যে আসে সব।
[আরও পড়ুন: রাস্তায় অমিল বেসরকারি বাস, রাজ্যে বিধিনিষেধ শিথিল হলেও ভোগান্তির শিকার নিত্যযাত্রীরা]
বর্ধমানে বেড়ে ওঠা বছর পঁচিশের নিবেদিতা দিল্লিতে পড়াশোনা শেষ করে দেরাদুনে একটি সংস্থায় দোভাষীর চাকরি করতেন। গত অক্টোবরে অঙ্কিতের সঙ্গে এক বন্ধুর মাধ্যমে আলাপ হয় নিবেদিতার। উত্তরাখণ্ডের ওই শহরেই কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা চালায় অঙ্কিত। আদতে সে উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) সাহরানপুরের ছেলে। অন্তরার কথায়, আলাপের পর দ্রুত নিবেদিতা ও অঙ্কিতের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। জানুয়ারি থেকে একত্রে বসবাস শুরু করে তারা। অঙ্কিতের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার কথা তাঁর বাবা-মাকেও জানান নিবেদিতা। কিন্তু এপ্রিলের ২৮-এর পর তাঁর সঙ্গে বর্ধমানের বাড়ির কেউ কথা বলে উঠতে পারেনি। পুলিশকে অঙ্কিত জানিয়েছে, দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হওয়ায় গত ২৮ এপ্রিল নিবেদিতা দেরাদুনে রাজপুর রোডে তাঁদের ফ্ল্যাটের চার তলার ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দেন। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে সঙ্গিনীর দেহ গাড়িতে তুলে ১৫ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয় সে।
প্রশ্ন উঠছে, নিবেদিতার পরিবারের কাউকে তাঁর মৃত্যুর খবর কেন জানাল না অঙ্কিত? অন্তরার অভিযোগ, তাঁর বোনকে খুন করে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়ার ছক কষেছিল অঙ্কিত। এখন নিজেকে বাঁচাতে নিবেদিতার আত্মঘাতী হওয়ার গল্প ফেঁদেছে। অঙ্কিত যে ইচ্ছাকৃতভাবেই নিবেদিতাকে হত্যা করেছে তা প্রথম সন্দেহ করেন অন্তরাই। পেশায় নাট্যকর্মী অন্তরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “এপ্রিলের শেষ থেকেই বোনের ফোন পাচ্ছিলাম না। অথচ ওর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ চালু ছিল। সেখান থেকে আমার সঙ্গে চ্যাট হত। কিন্তু মোবাইলে ফোন করলে সুইচ অফ করে দেওয়া হত। এদিকে অঙ্কিতের সঙ্গে আমাদের কারও তেমন পরিচয় ছিল না। ও আমার ফেসবুকে বন্ধুও ছিল না। ওর ফেসবুক প্রোফাইল লকড থাকায় ওর বিষয়ে কিছু জানতেও পারছিলাম না। ফেসবুকে আমাদের মাসতুতো বোনের বন্ধু ছিল ও। ওই বোনের অ্যাকাউন্ট থেকে অঙ্কিতের সঙ্গে চ্যাট করে জানতে চাই নিবেদিতার কথা। ও তখনও কিছু জানায়নি। এরপর জুনের মাঝামাঝি ও একদিন আমাদের চাপে পড়ে জানায় নিবেদিতার মৃত্যুর কথা। এরপর অঙ্কিতের ফোন থেকে এক মহিলাও আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, অঙ্কিতের ধূমপানের নেশা নিয়ে নিবেদিতার সঙ্গে ঝগড়া হয়। তারপরেই নাকি নিবেদিতা ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ দিয়েছে।” পরে তাঁরা জানতে পারেন নিবেদিতার ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ থেকে থেকে অঙ্কিতই চ্যাট চালাত দিদি বা অন্যদের সঙ্গে।
[আরও পড়ুন: ধর্ষণের পর পুড়িয়ে খুন? পথের পাশে তরুণীর অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ উদ্ধারে চাঞ্চল্য বর্ধমানে]
জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাবা ও কয়েকজন আত্মীয়কে নিয়ে দেরাদুন পৌঁছে যান অন্তরা। সেখানে অঙ্কিতের নামে এফআইআর দায়ের করেন তাঁরা। পুলিশের জেরার মুখে অঙ্কিত মুসৌরির কিমরি জঙ্গলে নিবেদিতার দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে নেয়। রাজপুর থানার পুলিশ অফিসার রাজেশ শাহ জানান, “জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে আমরা হাড়, মাথার খুলি, একটা হাত ও একটা পায়ের হাড় উদ্ধার করেছি। সেগুলি যে নিবেদিতারই তা নিশ্চিত করেছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। খুনের মামলা দায়ের করে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” পুলিশের মতে, নিবেদিতার ব্যালকনি থেকে পড়ে যাওয়া নিয়ে মিথ্যা গল্প সাজিয়েছে অঙ্কিত। এরকম হলে কেন সে অ্যাম্বুল্যান্স না ডেকে নিজের গাড়িতে দেহ তুলে নিল? যে ফ্ল্যাটে অঙ্কিতরা থাকে সেখানে ব্যালকনিতে চার ফুট উঁচু গ্রিল লাগানো আছে। এমনকী ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিবেদিতাকে তাঁরা কোনওদিনই সেখানে দেখেননি। কী কারণে অঙ্কিত তার লিভ-ইন পার্টনারকে খুন করল সেই প্রশ্নই উঠে আসছে তদন্তে। একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, ব্যালকনি থেকে পড়লে নিবেদিতার হাত-পা কেন কাটা অবস্থায় পাওয়া গেল? অঙ্কিতকে নিবেদিতার দেহ পোড়ানোর কাজে কয়েকজন বন্ধু সাহায্য করেছিল বলে সন্দেহ পুলিশের। একইসঙ্গে অন্তরার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলা ওই রহস্যময়ী নারীরও খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ। যিনি ফোনে নিবেদিতাকে খুঁজে বের করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
বুধবারই দেরাদুন থেকে বর্ধমানে ফিরেছেন অন্তরা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। জানালেন, পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পরও অঙ্কিত তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেছিল, “যা করার করে নাও। আমার কী আর করবে? ফাঁসি দেবে!” বোনকে হারানোর শোক মনে পাথর হয়ে জমাট বাঁধলেও আগে তাই অঙ্কিতের শাস্তি দাবি করছেন অন্তরা। যেভাবেই হোক বোনের মৃত্যুর সুবিচার চাই তাঁদের। ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ ছবিতে বিদ্যা বালনের মতোই বোনের খুনির শাস্তি আদায় করে ছাড়ার পণ করেছেন বর্ধমানের মুখোপাধ্যায় বাড়ির বড় মেয়ে।