কানাডার খালিস্তানি ইস্যু হোক বা মালদ্বীপের নয়া প্রেসিডেন্ট পদে চিনপন্থী রাষ্ট্রনেতার আবির্ভাব, ভারতে তালিবান সরকারের দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আফগানিস্তানের গোঁসা হোক বা নেপাল-ভুটানের চিনপ্রেম– ’২৪-এর আগে নরেন্দ্র মোদি যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তা তুলে ধরেছে তাঁকে নিয়ে লেখা মিনহাজ মার্চেন্টের নতুন বই ‘মোদি– দ্য চ্যালেঞ্জ অফ ২০২৪, দ্য ব্যাটল ফর ইন্ডিয়া’। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল।
নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। লেখক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মিনহাজ মার্চেন্ট। বইটির নাম ‘মোদি– দ্য চ্যালেঞ্জ অফ ২০২৪, দ্য ব্যাটল ফর ইন্ডিয়া’। মিনহাজ মার্চেন্ট এমন একজন জীবনীকার, যিনি অতীতে রাজীব গান্ধী এবং প্রয়াত শিল্পপতি আদিত্য বিড়লার জীবনীও লিখেছিলেন। বইটি ঠিক মোদি-বিরোধী বই নয়। কিন্তু দেশে এবং বিদেশে ২০২৪-এর আগে নরেন্দ্র মোদি যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, সেগুলো সবিস্তার বর্ণনা আছে এই বইতে। শুধু দেশের ভিতরে নয়, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে, এমনকী, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রেও– যেমন চিন এবং আমেরিকাকে সুষ্ঠু বিদেশনীতির মাধ্যমে কী করে মোকাবিলা করা যাবে– এসব নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন।
এই মুহূর্তে ভারতের শিরঃপীড়ার সবচেয়ে কারণ হয়ে উঠেছে কানাডা। পাশাপাশি মালদ্বীপে শাসক-বদল আর চিনের প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কাও ভারতকে ভাবাচ্ছে। ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। সেখানে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী দল ‘পিপল’স ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর প্রার্থী মহামেদ মুইজ্জু। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৪-৫৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ১৭ নভেম্বর তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার কথা। নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ‘মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি’-র নেতা ইব্রাহিম মহামেদ সলিহ্। মহামেদ মইজ্জু চিন-ঘেঁষা হিসাবে পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে দেশটির নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগী ভারতের প্রতি তঁার আগ্রহ বরাবরই কম। অন্যদিকে, মহামেদ সলিহ্ ভারতপন্থী ছিলেন। তঁার এই পরাজয়ের পর ভারতের বিদেশমন্ত্রকের আকাশে আশঙ্কা কালো মেঘ।
[আরও পড়ুন: পাতায় পাতায় বিপুল লেনদেনের হিসাব! আর কী রয়েছে জ্যোতিপ্রিয়র নাম লেখা ‘মেরুন ডায়েরি’তে?]
মালদ্বীপের সঙ্গে চিনের কূটনৈতিক সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৭২ থেকে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হেলিকপ্টার নিয়ে। ২০১৩ সালে ভারত বেশ কিছু হেলিকপ্টার মালদ্বীপকে দিয়েছিল, উপহার হিসাবে। ৩০ জুন তার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেগুলো এখন ফেরত চাইছে ভারত। এদিকে, মালদ্বীপকে চিন ভারতের হেলিকপ্টার ভারতকে ফেরত দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। হেলিকপ্টার-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিয়ে তারা মালদ্বীপের পাশে দঁাড়াবে বলে আশ্বস্তও করেছে। চিন মালদ্বীপে রাস্তা বানাচ্ছে। সেতু বানাচ্ছে। বিমানবন্দর বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দুই রাষ্ট্র একত্রে ‘সিনামেল সেতু’ নামে এক মৈত্রী-সেতু নির্মাণ করছে। এই ঘটনাগুলোই ভারতের মাথা ব্যথার কারণ। মালদ্বীপ যতই ছোট দেশ হোক না কেন, তা সমস্যা তৈরি করছে। কেননা, চিন এবং পাকিস্তান– এই অক্ষ আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
এদিকে, ভারতে আফগানিস্তানের দূতাবাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আফগানিস্তানের অভিযোগ, ভারত তাদের যথেষ্ট আর্থিক এবং অন্যান্য পরিষেবা দেয়নি। সে-কারণে দূতাবাসটি বন্ধ করতে হয়েছে। তালিবান সরকারের সঙ্গে ভারতের যে-সুসম্পর্ক, কূটনৈতিকভাবে তা-ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সরকার গঠনের পর ভারত উৎসাহ নিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। আর্থিক সাহায্যও অব্যাহত রাখে। এই এনগেজমেন্ট তৈরির জন্য রাশিয়াও ভারতকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। প্রশ্ন, এখন এমন কী হল যে, ভারত আফগানিস্তানের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে? কার অঙ্গুলিহেলনে? কেন? এটায় ভারতের সার্বভৌম স্বার্থ কী?
[আরও পড়ুন: ‘ধর্ষণ, লুঠ, ডাকাতিতে মুসলিমরাই এক নম্বর’, সংখ্যালঘু নেতার মন্তব্যে তুঙ্গে বিতর্ক]
পরিস্থিতি ঘোরালো। কেননা, নেপাল এবং ভুটানের মতো ছোট-ছোট দেশও চিনের প্রভাবান্বিত। আর এসবের মধ্যে চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও যে একটিমাত্র প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ বজায় রেখেছে যৌথভাবে বিদেশনীতি কার্যকর করে, সে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেও ভারতের সঙ্গে কখনও নিজের সম্পর্কে চির ধরতে দেয়নি। এই বিশ্বাসযোগ্যতা থেকেই ভারতও বাংলাদেশের উপর এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আরও অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
তবে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে কানাডা। খালিস্তানি জঙ্গির হত্যা নিয়ে পরিস্থিতি সরগরম। সংখ্যালঘু খালিস্তানি শক্তির সমর্থনে কানাডা সরকারের টিকে থাকা অনেকাংশে নির্ভরশীল। কানাডায় খালিস্তানি জঙ্গি-হত্যার ব্যাপারে সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরাসরি দোষ দিয়েছেন ভারতের উপর। অভিযোগ, ভারতের ‘র’-র মতো সংস্থা– অর্থাৎ ভারতীয় গোয়েন্দারা– কানাডার জমির মধ্যে ঢুকে এই হত্যাকাণ্ড করেছে। গোয়েন্দাদের জন্য এটা মস্ত সাফল্য হতে পারে, তবে এতে ফঁাপরে পড়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
তাও আবার ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে আগেই! প্রকাশ্যে কোনও বিবৃতি না দিলেও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের বিরুদ্ধে কানাডার অভিযোগ, একটি অডিও টেপে তঁাকে নাকি নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে– ভারতের গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে গোয়েন্দা কর্তাদের কথোপকথন চলাকালীন। যদিও ভারত সরকার এ বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মেও সরকারিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এসবের কোনও ভিত্তি নেই।
বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর অবশ্য এই পরিস্থিতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। যদিও তঁার সঙ্গে অজিত ডোভালের কাজকর্ম করার পার্থক্য চিরকালই ছিল। আমরা বলতাম, এটা ফরেন সার্ভিসের সঙ্গে পুলিশদের মতপার্থক্য। নরেন্দ্র মোদি যাতে কূটনীতির এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেষ হাসিটা হাসতে পারেন, জয়শঙ্কর তার ব্যবস্থা করছেন।
তিনি আমেরিকায় গিয়েছেন। আমেরিকার বিদেশসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এস. জয়শঙ্কর স্বীকার করেছেন যে, তিনি কানাডা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ভারতের সঙ্গে যাতে সম্পর্ক বিনষ্ট না হয় তার জন্য কানাডার বিদেশমন্ত্রী মেলানি জলি—ও সক্রিয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিদেশমন্ত্রীকে তিনি ফোন করছেন। সোজাকথায়, ভারত এবং কানাডা
দু’-পক্ষই এখন কিছুটা বোঝাপড়ায় আসতে চাইছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক বিষয়, সর্বোপরি চিনের মতো থ্রেট– সেখানে কানাডার একটা ফ্রন্ট খোলা। আর তাই আইএসআই এবং খালিস্তানিদের সম্পর্ক বা খালিস্তানি আন্দোলনে পাকিস্তানিদের ভূমিকা– এসব বিষয় থেকে বিজেপিকে কিছুটা সরে আসার পরামর্শ দিচ্ছে শীর্ষ নেতৃত্ব।
পাঞ্জাবের উপরেও এর প্রভাব পড়েছে। লালকৃষ্ণ আদবানি একবার আমাকে বলেছিলেন– শিবসেনা নয়, বস্তুত এনডিএ-র সবথেকে প্রাচীনতম শরিক হচ্ছে, আকালি দল। নির্বাচনের আসন সংখ্যাও যদি তাদের কমে যায়, তাহলেও আমরা আকালি দলকে ছাড়তে চাই না। কেননা, আকালি হচ্ছে পাঞ্জাবের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দল।
‘অপারেশন বুস্টার’-এর পর পাঞ্জাবিদের যে কংগ্রেস-বিরোধিতা, ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বিদ্বেষ, তা মনে রেখে মনমোহন সিংহকে পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে হয়েছে বহুবার। সেখানে এখন আকালি-বিজেপির সম্পর্ক শুধু ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যে বিচ্ছিন্নতা বোধ পাঞ্জাবের থেকে গিয়েছে, তা উসকে দেওয়া কাজের কথা নয়। সম্ভবত সেই কারণে আকালির সঙ্গে আবার বিজেপি নতুন করে বোঝাপড়ায় যেতে চাইছে। ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করা না, ক্ষেত্রেবিশেষে শান্তি-প্রক্রিয়া এবং আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েও যে সমঝোতায় অাসতে হয়, তা নরেন্দ্র মোদি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। এবং তা কেবলমাত্র বিদেশনীতির ক্ষেত্রেই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পরিচালনা করতে গিয়েও।
আর এসব কারণেই ’২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের ভিতরে এবং বাইরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পর, দল এবং আরএসএসের রণকৌশলের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি এবং তঁার ভূমিকার মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। মিনহাজ মার্চেন্ট– মোদির জীবনীকার– এই বইটিতে দেখিয়েছেন– ধীরে ধীরে মোদিও ‘দ্বিতীয় বাজপেয়ী’ হয়ে উঠতে চাইছেন।
বাজপেয়ীর সময় আডবানি ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির সময় অমিত শাহ এবং যোগী আদিত্যনাথ সেই কট্টরপন্থী ভাবমূর্তির প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে মোদির পক্ষে ’২৪-এর নির্বাচনের আগে স্বীয় ভাবমূর্তিকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে কি না তা সময় বলবে।
(মতামত নিজস্ব)