অতুলচন্দ্র নাগ, ডোমকল: বাবা ১৯৬২ সালে লাদাখে ভারত-চিন যুদ্ধে লড়েছিলেন। ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভলান্টিয়ার সৈনিক। তাঁরই ছেলে ধরা পড়েছে আল কায়দা (Al-Qaeda) জঙ্গি সন্দেহে! ছেলে আল কায়দা জঙ্গি, এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না দেশের প্রতি ইমানদার বাবা। মুর্শিদাবাদের ডোমকলের নওদাপাড়ার বাড়িতে বসে কথা প্রসঙ্গে বললেন, “মুসলমানের আসল ইমান তো দেশপ্রেম। আমার রক্তে গড়া সন্তান কখনও দেশদ্রোহিতা করতে পারে না। আমার ছেলে জঙ্গি প্রমাণ হলে চাইব, অবশ্যই তার শাস্তি হোক। কিন্তু অন্যায় ভাবে তাকে যেন ফাঁসিয়ে দেওয়া না হয়। ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ কতটা সত্য তাও যাচাই হওয়া দরকার।”
১৯৬২ সালে ফর্জ আলি মণ্ডল লাদাখে গিয়েছিলেন চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে। এবার তাঁর নিজের বাড়িতেই আগ্রাসন চালিয়েছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা। কবজা করে নিয়েছে ছেলেকে। দেশভক্ত সৈনিকের বিপন্ন ও বিভ্রান্ত মুখে আজ তাই অসহায়তার ছাপ। এনআইএ হেফাজতে থাকা ছেলে আল মামুন কামালের মুখটা বার বার ভাসছে চোখের সামনে। কিছুতেই মানতে পারছেন না নিজের ছেলে দেশদ্রোহী।
শনিবার ভোরে আল কায়দা জঙ্গি সন্দেহে আল মামুন কামালকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এনআইএ (NIA) টিম। নিয়ে গিয়েছে বেশ কিছু নথিপত্র। যার কিছু অবশিষ্ট বাড়িতে পড়েও রয়েছে। বাড়ির লোকেরাই মাদ্রাসার চাঁদা তোলার রসিদ দেখিয়ে বলেন, “গোয়েন্দারা বলছেন, এগুলোই নাকি জঙ্গি কার্যকলাপের প্রমাণ! চাঁদা তুলে ছেলে জঙ্গি কার্যকলাপ করত, এমনটাই রটানো হচ্ছে। আসলে তা নয়।” প্রতিবেশী শাজাহান মণ্ডল জানান, “এলাকায় শুধু নয় ওই রসিদের সাহায্যে কেরল থেকেও মাদ্রাসা মসজিদের জন্য চাঁদা তোলা হত। আমরাও চাঁদা দিয়েছি”। আল মামুন কামালের বাড়ির পাশেই নির্মীয়মাণ একটি মসজিদ রয়েছে। আর কোরান শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা। বাড়ির পুরনো ঘরের পাশেই নতুন ভাবে পাকা ঘর নির্মিত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মনে। হঠাৎ করেই যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে সব নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগেই পরিবারের দাবি, মামুন খুব কর্মঠ ছেলে। কখনও কেরলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতো, মাঝে মাঝে গাড়িও চালাত। এমনকী এর আগে এক সময় ছ’মাস জলঙ্গি থানার গাড়িও চালিয়েছে। লকডাউনের সময় পানের হকারিও করেছে সে। এসব করে পয়সা জমিয়ে ওই বাড়ি বানিয়েছে। এসবের পাশাপাশি ধর্মীয় চর্চাতেও তার একনিষ্ঠতা ছিল।
[আরও পড়ুন: রাজ্যে মোট করোনার বলি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার, উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কলকাতা-সহ এই পাঁচ জেলা]
জানা গিয়েছে, শনিবার ভোরে এনআইএ আল মামুনকে গ্রেপ্তারের আগেরদিন শুক্রবার সন্ধেয়ও পাঁচ-ছ’জন যুবক বাড়িতে গোপন মিটিং করেছে। ওই ব্যাপারে মামুনের স্ত্রী আসুয়ারা বিবি জানান, “ধর্মীয় আলোচনার জন্যই ওরা এসেছিল। তবে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে? কারাই বা এসেছিল? কখন তারা চলে গিয়েছে সে ব্যাপারে কিছু জানি না”। তিনি জানান, “ওই আলোচনায় মহিলাদের থাকার নিয়ম নেই, তাই বলতে পারব না।” তবে এনআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে আল মামুন কামালের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কাগজপত্র ও মোবাইলের তথ্য নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। সেদিন কারা এসেছিল ওর বাড়িতে মিটিং করতে তাও জানার চেষ্টা চলছে।
এদিকে, আলকায়দা জঙ্গি সন্দেহে ধৃত সহকর্মী লিয়ন আহমেদ সম্পর্কে মুর্শিদাবাদের ডোমকল বসন্তপুর কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিস বন্দোপাধ্যায় বলেছেন,“ দশ বছর ধরে চেনা সহকর্মী কী করে জঙ্গি হল বুঝতে পারছি না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যার সঙ্গে দীর্ঘদিন আছি তাকেই চিনতে পারলাম না তাহলে।” শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ডোমকল মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান চালিয়ে এনআইএ যে ছ’জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে ধরেছে, তাদের একজন ওই লিয়ন আহমেদ। ডোমকল কলেজ থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভোকেশনাল কোর্সে পড়ার পর ওই কলেজই ক্যাজুয়াল ষ্টাফ হিসেবে জয়েন করে বছর দশেক আগে। দারিদ্রের কারণেই তার আর পড়াশোনা হয়নি। লিয়নের বেতন সাড়ে সাত হাজার টাকা হয়েছে। তার বোন সাহানুর খাতুনের দাবি, “ঘরবাড়ি না থাকার কারণে দাদা বিয়ে করেনি। সেই কিনা জঙ্গি? নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।” চাকরির বাইরে কার কার সঙ্গে সে যোগাযোগ করতো জানেন? সেটা বলা সম্ভব নয়। এলাকায় সীমিত কিছু লোকের সঙ্গে ওঠাবসা। আলোচনার বিষয়ও সেই ধর্মচর্চা। তাছাড়া চুপচাপ থাকতো। কলেজেও অনুপস্থিতি ছিল কম। তবুও তার শরীরের বর্ম হিসেব লোহার পাতের জ্যাকেট তৈরি করা নিয়ে এলাকার মানুষের কৌতূহল তুঙ্গে। সবার জিজ্ঞাসা, কী এমন প্রয়োজন পড়ল যে তাকে স্টিলের পাতের জ্যাকেট বানাতে হল? তাহলে ওই জ্যাকেট পরে কোথায় সে হামলার ছক কষছিল? ওই কলেজেই বিএসসি দ্বিতীয় বর্ষে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করতো জঙ্গি সন্দেহে ধৃত ছাত্র নাজমুস সাকিব। শনিবার তাকেও এনআইয়ে গ্রেপ্তার করেছে। সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস হত কলেজে, তাতেও সে নিয়মিত ছিল না। কলেজের অন্যান্য স্টাফেরা জানান, সে খুব কম কথা বলতো বন্ধুদের সঙ্গে। মেলামেশাও কম করত। ওই কলেজের অধ্যক্ষ জানান, “ নাজমুস খুব কম আসত। দেখতাম খুব চুপচাপ থাকত।” কলেজের এক পড়ুয়া, একজন ক্যাজুয়াল স্টাফের নাম জড়িয়ে পড়ল জঙ্গি কাজকর্মে। তাহলে আগামী দিনে ছাত্রভরতি বা কর্মী নিয়োগের সময় নিয়মে কিছু পরিবর্তন আনা হবে কি? ওই ব্যাপারে অধ্যক্ষ জানান, “ওই বিষয় গুলি সরকারের নির্দিষ্ট নিয়মে হয়। তাই ওই ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না।
[আরও পড়ুন: ‘অপদার্থ সাংসদ’, কেশপুর থেকে নাম না করে দেবকে বেনজির আক্রমণ ভারতী ঘোষের]
The post ‘আমার ছেলে আল কায়দা হলে শাস্তি হোক’, সাফ কথা ডোমকল থেকে ধৃত আল মামুনের বাবার appeared first on Sangbad Pratidin.