অরিঞ্জয় বোস: প্রিয় সৌরভ আঙ্কল,
প্রথমেই তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সারা বাংলা, সারা ভারত… আর শুধু দেশ কেন, সারা পৃথিবী থেকেই আজ নিশ্চয়ই শুভেচ্ছার বাহারি ফুল এসে জমা হয়েছে তোমার দরজায়। সেটাই স্বাভাবিক। উইলো কাঠের ‘রাজদণ্ড’ হাতে একদা ক্রিকেট-পৃথিবীকে শাসন করেছেন যে মহারাজ, আজ শুভেচ্ছার আলোয় তাঁর ভুবন ভরে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে! আমিও অবাক হচ্ছি না মোটেই। আমি জানি, তুমি যতখানি এই বাংলার, তার থেকেও বেশি এই দেশের। ভারতবর্ষের জনতা যে সৌরভে আমোদিত, তাঁকে কেবল বঙ্গবাসীর বলে দাবি করাও বোধহয় উচিত নয়। কিন্তু তারপরেও, তোমার উপর বাংলার মানুষের দাবি একটু বেশিই থেকে যায়। আর সেই জায়গা থেকেই তোমার জন্মদিনে এই খোলা চিঠি লিখতে বসা।
যে সময় তুমি তোমার ক্রিকেটীয় উৎকর্ষের শীর্ষে ছিলে, কালের নিয়মেই সেই সময়টাকে আমরা পেরিয়ে এসেছি। মাঝখানে চলে গিয়েছে ধোনিযুগ। এমনকী কোহলি-সভ্যতার সূর্যেও গোধূলির রং ধরেছে। তারপরেও এখনও অধিনায়ক শব্দটি উচ্চারিত হলে, দেশের ক্রিকেটপাগল মানুষের চোখে একটা মুখই ভেসে ওঠে। সমুদ্রনীল জার্সিতে ফুটে ওঠা সে-মুখ এক বঙ্গতনয়ের। আমরা জানি, সে আসলে আমাদের ‘বেহালার ছেলে’টি। যে ব্যাট হাতে নামলে সারা বাংলার মানুষ উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকত সেকালে। একটা স্টেপ আউট… একটা বাপি বাড়ি যা…। জেগে থাকত অপেক্ষা। সেই সঙ্গে অন্তরের অন্দরে দুরুদুরু চিন্তা। দেখো বাবা, যেন কোনও অঘটন না ঘটে! ছেলেটার ব্যাটে যেন রান আসে। আসলে সেই প্রতিটি রান তো তোমার একার ছিল না, বরং যেন ছিল বাংলার মানুষের। যাঁরা ক্রিকেট ভালবাসতেন তাঁদেরই শুধু নয়, যাঁরা বাংলার মাটিকে ভালবাসেন তাঁদের প্রত্যেকেরই। বঙ্গবাসী হিসাবে নানা অভাব-অভিযোগ তো থেকেই যায়। এই বাংলায় এই নেই, ওই নেই… এসব হিসাব-নিকাশ চলতেই থাকে। সেদিনও ছিল। কিন্তু সেদিন সকলেই জানত, তাদের আর কিছু থাক কিংবা না-থাক, আছে একজন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সমস্ত অপ্রাপ্তির উপর, সমস্ত খামতির মুখের উপর দিয়ে সে ঠিক তুলে আনবে প্রাপ্তির ফুল। তা ছেলেটি এনেওছিল বটে। শুধু রানের ফুল ফোটানো নয়, দেশের হয়ে নানাবিধ সম্মান অর্জন করতে করতে এই বাংলার জন্যও ছেলেটি তুলে এনেছিল প্রাপ্তির কুসুম। সেদিন তাই বাঙালির হৃদয়পুর আমোদিত হয়েছিল অফুরান সৌরভে। সে আমেজে আজও বুঁদ বাংলা।
[আরও পড়ুন: হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পরই সিদ্ধান্ত বদল, অবসর প্রত্যাহার তামিমের]
একদিন গোটা দেশ দেখল, সেই ছেলেটির মাথায় উঠেছে অধিনায়কের টুপি। দেশের ক্রিকেটে সে-ও বেশ সংকটের মুহূর্ত। দেশকে জাগিয়ে তুলতে গেলে চাই এমন একজনকে, যিনি হয়ে উঠবেন স্পর্ধার সমনাম। বঙ্গবাসী সেদিন ফের দুরুদুরু বুকে ভাবতে বসেছিল, ছেলেটি পারবে তো! এই ঝড়ো হাওয়ার দিনে হাল ধরা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আর ছেলেটি বোধহয় মনে মনে বলেছিল, হাল ছেড়ো না। তা ছেলেটি পারল বটে! এমন ভাবে নিজের কীর্তিগাথা সাজিয়ে তুলল যে, দেশের ক্রিকেটে ‘দাদার কীর্তি’ আলাদা একটি অধ্যায় হয়ে রইল। সেদিনের সেই আগুন-ঝরানো অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথকে আটকানো সম্ভব হত যদি না থাকতে তুমি! দলে প্রতিভার সেদিনও অভাব ছিল না। ছিলেন শচীন তেণ্ডুলকর, যিনি কিনা উত্তরকালে হয়ে উঠবেন ‘জাতিশ্বর’। ওদিকে রাহুল দ্রাবিড় থেকে লক্ষ্মণ-কুম্বলে, পরে চলে এলেন শেহবাগ-হরভজন-জাহিরের মতো একঝাঁক তরুণ তুর্কি। প্রতিভার নিরিখে সে তো এক ঈর্ষণীয় সমাবেশ। তবে বিশ্ব জানে, সেদিন মালা গাঁথার কাজটি করেছিলেন এই বঙ্গতনয়ই। দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের চোখ চোখ রেখে লড়াই করার সাহস। ক্রিকেট-অরণ্যে সেদিনকার প্রাচীন প্রবাদ ছিল এই যে, ভারত দেশের মাটিতে শার্দূল আর বিদেশে মার্জার। বাংলার ছেলেটি সেই প্রবাদ পালটে দিক এক ধাক্কায়। বিদেশের মাটিতেও সেদিন রুখে দাঁড়াল ভারত-বাহিনী। ছেলেটির কলার-তোলা স্পর্ধা যেন নবজাগরণ আনল দেশের ক্রিকেটে। তারপর তো সে এক অন্য রূপকথা। যা ছিল অলীক কল্পনা, তাই একদিন বাস্তব হয়ে ধরা দিতে শুরু করল। ভারতের ক্রিকেট ক্রমাগত এগোতে থাকল সেই পথের দিকে, যে-পথ ধরেই পরবর্তী প্রজন্ম একদিন পৌঁছে যাবে সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে। নেপথ্যের সলতে পাকানোর কাজটি সেদিন যে তুমিই করেছিলে তা আজ সকলেই জানেন। সাফল্যের পথ গড়ার কাজটি যিনি করে দিয়েছিলেন, তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই। বাঙালি হিসাবে আমাদের কি তাতে গর্ব হবে না!
বাঙালি আজও তোমাকে নিয়ে সেই একই রকম গর্বিত। তোমার ক্রিকেট ছাড়ার পর শুধু ক্রিকেট নয়, দেশের মধ্যেও যে কতরকম পালাবদল হয়েছে তার ঠিক নেই। পটপরিবর্তনের সাক্ষী থেকেছে এই বাংলাও। রাজনীতির হাওয়া এসে বাঙালিকে সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে এদিক থেকে ওদিকে। অনেকরকম ভাগাভাগি যে বর্তমানে আছে, তা অস্বীকারের জায়গা নেই। তবে সে সব পেরিয়ে এক তীর্থে সব বাঙালি আজও এক। সে তীর্থের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। শত রাজনীতি, শত বিভেদ পেরিয়েও সকলেই আজও এই নামে আন্দোলিত হয়ে ওঠে। আর সেই কথাটাই সব বাঙালির হয়ে তোমাকে নতুন করে বলার। এই নতুন দিনের ভোরেও তুমিই আমাদের একজোট হওয়ার কাণ্ডারি।
[আরও পড়ুন: বেনারসী পরে বাইকে চালাচ্ছেন ঋত্বিকা সেন, অভিনেত্রী চললেন কোথায়?]
গতবছর পঞ্চাশ পেরিয়ে তুমি এবার একান্নতে। আর তোমাকে ছুঁয়েই আমরা আজও একান্নবর্তী।
আরও একবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা। ভাল থেকো। বেঁধে বেঁধে রেখো বাঙালিকে।