যখন মনে করা হচ্ছিল পর পর ঢেউ সামলে আবার আমরা আগের জীবনে ফিরে যাব, তখন আফ্রিকায় নতুন রূপে হানার খবর। নতুন তার ক্ষমতা। ইউরোপে ডেল্টার দাপটে আবার লকডাউনের পথে কিছু দেশ। তাহলে কি ফের আসছে মৃত্যুদূত? নতুন বেশে? গতবার কিছু বোঝার আগে সে আক্রমণ হেনেছিল। মানুষ যখন ধরে নিয়েছিল, করোনা বিদায় নিয়েছে, তখনই আঘাত। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক
করোনা ‘পজিটিভ’ হওয়ার অভিঘাত এতটাই হৃদয়স্পর্শী যে, দিনটি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর অতিমারীর স্রোতে আমিও ভেসেছিলাম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। মহামারীর একশো বছরে এমন দুর্ভাগ্য অথবা সৌভাগ্য একবারই হয়।
গতবছর ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জানতে পারি, প্রায় সাড়ে আটমাসের অনুশাসনে নিজেকে বন্দি করার ‘নিট’ ফল শূন্য। আমি পরাজিত। ‘কোভিড ১৯’ হানা দিয়েছে শরীরে। অজান্তে বাসা বেঁধেছে মারণ ভাইরাস। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা যায় কোভিড সদ্য প্রবেশ করেছিল ফুসফুসে। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুচিকিৎসায় ও আদরে কোভিড-মুক্ত হয়ে ১১ দিন পর বাড়ি ফিরি।
‘আদর’ শব্দটি ব্যবহার এই কারণেই যে, অবাক হয়ে দেখেছিলাম দিনের পর দিন ‘পিপিই’ নামক অদ্ভুত পোশাকে আপাদমস্তক নিজেদের ঢেকে কতগুলো মানুষ জীবনকে বাজি রেখে করোনা রোগীদের সুস্থ করার লড়াই করছেন। তিনি ডাক্তার হতে পারেন, নার্স হতে পারেন, সাফাইকর্মী হতে পারেন, তিনি চা-বিস্কুট নিয়ে ভোরে ঘুম ভাঙাতে আসা সাধারণ কেউ হতে পারেন। তাঁদেরও পরিবার আছে। চোখে স্বপ্ন আছে। ভালবাসা আছে। ঘরে অপেক্ষার মানুষ আছে।
[আরও পড়ুন: কৃষি আইন প্রত্যাহার নির্বাচনী চাল, না কি বোধোদয়?]
তবু তাঁরা মানবিক মন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সংগ্রামে। ভাইরাসের আঁতুড়ে হাসি মুখে কাজ করছেন। মৃত্যু তাঁদের কাছে বড় নয় কর্তব্যের চেয়ে। চোখের সামনে সেই দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল- যুদ্ধক্ষেত্র যদি বলতেই হয়, তবে তো এটিই। এমন ‘ওয়াটারলু’ আগে কখনও কেউ দেখেনি। তাঁদের জন্যই সুস্থ হয়ে
উঠলাম। ফিরে পেলাম ঘর-সংসার-পরিজন, প্রফেশন।
যদিও সেই দিনগুলোর কিছু স্মৃতি মনে পড়লে ভিতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। সেদিন স্ক্যান করাতে আমাকে ন’তলা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পাশের বাড়িটায়। অ্যাটেনডেন্ট বললেন, ‘হুইলচেয়ারে চলুন।’ তাঁকে বললাম, ‘না না, বেশ তো হাঁটাহাঁটা করছি। জ্বর—টরও নেই। খামোকা হুইল চেয়ারে বসব কেন?’
বাহাদুরির ফল পাই পথে নেমে। মাথা ঘুরতে শুরু করে। প্রথমে অল্প। তারপর অনন্ত সেই ঘোরা। সারা পৃথিবী যেন চোখের সামনে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে! সোজা করে তাকাতে পারছি না। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে হুমড়ি খেয়ে পড়ব। ঠিক সেই সময় একটি দৃশ্য। সাদা পলিথিনে মোড়া একটি লাশ পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটি রাখা হল একটি শববাহী গাড়িতে। করোনার কাছে পরাজয়ের দীর্ঘ মিছিলে নাম লেখালেন আরও একজন।
আমি কেমন বিহ্বল হয়ে গেলাম। মৃত্যু এত সহজ! বুকটা কেঁপে ওঠে। এই তাহলে পরিণতি? সাধের জীবনের এমন সমাপ্তি? এত চাওয়া, পাওয়া, লোভ, ক্ষোভ, ক্রোধ, উল্লাস, উৎসব- সব এক নিমেষে শেষ? অদৃশ্য এক ভাইরাসের ছোবলে এত অসহায় মানবজাতি?
মাথাটা আরও ঘুরে গেল। বসার জায়গা খুঁজছিলাম। আমাকে ধরে নিলেন সেই অ্যাটেনডেন্ট। সেদিন সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। চোখের সামনে সাদা প্লাস্টিকে মোড়া শবটা ঘুরছিল। কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। শুনেছিলাম, করোনা হলে মানুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। সেটা রোগীর ক্ষেত্রে আরও ভয়ংকর। নিজেকে আস্তে আস্তে সামলে নিই।
আরও একটি ঘটনা ঘটল একবারে পাশের বেডে। ডুকরে কাঁদছেন এক ডাক্তার। রোগী দেখতে দেখতে যিনি নিজেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। একটু আগে খবর এসেছে- তাঁর সহপাঠী, ডাক্তার স্ত্রী, ৩৪ বছরের সঙ্গী মারা গিয়েছেন। চোখের জলের বাঁধ মানছে না। বিলাপ করছেন আর ঈশ্বরকে বলছেন, ‘একই রোগের আলাদা পরিণতি কেন? ওকে নিলে আমাকেও নাও!’
নিজেকে সামলাতে পারিনি। কারণ, বাড়িতে করোনা আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী আমার স্ত্রী-ও। সৌভাগ্য, তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করতে হয়নি। এমনিই সুস্থ হয়েছেন। এখন যখন শুনছি আফ্রিকায় করোনার নতুন অবতার আবির্ভূত, তখন আবার পুরনো কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।
লকডাউন এক অভিশাপের নাম। কেউ চায় না সেই কালা সময় ফিরে আসুক। ভারতে করোনা রোগী একটু একটু করে বাড়ার পর ২০২০ সালের ২২ মার্চ ‘জনতা কারফিউ’ ঘোষণা হল। তারপর ২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে লকডাউন। শুধু দেশ কেন, সারা পৃথিবী স্তব্ধ। অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন থেকে ঝালার বস্তির সমীর বারিক, সবার শরীরে একই ভাইরাসের হানা।
সবাই অসহায়। মানুষ সব কাজ বন্ধ করে ঘরে বন্দি।
লকডাউনে স্তব্ধ কলকাতা। অফিস, স্কুল, কলেজ, ফুটপাতের দোকান, লোকাল ট্রেন, মেট্রো, বিমান- সব বন্ধ। সংবাদপত্রের স্তব্ধতা নেই। সাংবাদিকের নেই ছুটি। এই পরিস্থিতিতে অফিসে সবার আসারও উপায় নেই। কয়েকজন অফিসে আসি। এডিটর আসেন। প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। ভয়ে গুটিয়ে বিশ্ব। যখন কাজ সেরে ফিরতাম, নিশুতি রাত। অচেনা সেই কলকাতা। ফুটপাতে মানুষ নেই, ট্রামের ঘরঘর আওয়াজ নেই। রাস্তায় একটা কুকুরও দেখি না। মানুষ ভয়ে রাস্তার দিকে জানলা পর্যন্ত বন্ধ করে রাখত। প্রতিদিন মৃত্যুমিছিলে কত মানুষ, কত বিশিষ্টজন। কে বাঁচবে, কে মরবে- কেউ জানে না। ওষুধ নেই, টিকা নেই, অক্সিজেন নেই, হাসপাতালে বেড নেই। সমাজে হাহাকার। পাড়ায় পাড়ায় কান্নার রোল। গরিবের ঘরে খাদ্য শেষ হয়ে গিয়েছে। কাজ চলে গিয়েছে শ্রমিকের। কৃষক মাঠে যেতে ভয় পায়। কী দিন গিয়েছে এখন ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই, অক্সি-পালস মিটার ইত্যাদির সঙ্গে সেই পরিচয়। যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হবে বলেই প্রবল শৃঙ্খলায় নিজেকে মুড়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। করোনা সেই বাসা বাঁধলই। যেমন বেঁধেছিল হাজার হাজার পরিবারে। কথাগুলো অনেকের সঙ্গে মিলে যাবে। কারণ, এমন কোনও পরিবার নেই, যাদের কেউ না কেউ এই কালান্তক ব্যাধির শিকার হয়নি।
একবছর পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মানুষ টিকা পেয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আরও সর্বগ্রাসী হয়ে এলেও তার ঝাপটা কেটে গিয়েছে। অফিস চালু হয়েছে। স্কুল খুলেছে, বিমান উড়ছে, মানুষ আউটিং করছে, লোকাল ট্রেনে, বাসে আগের মতো উপচে পড়া ভিড়, উৎসবও হচ্ছে। মাস্ক মুখ থেকে নেমেছে থুতনিতে।
করোনা কিন্তু শেষ হয়নি। তাকে হারানো যায়নি। রূপ বদলে সে আঘাত হেনেই চলেছে। তবু যখন মনে করা হচ্ছিল পর পর ঢেউ সামলে আবার আমরা আগের জীবনে ফিরে যাব, তখন আফ্রিকায় নতুন রূপে হানার খবর। নতুন তার ক্ষমতা। ইউরোপে ডেল্টার দাপটে আবার লকডাউনের পথে কিছু দেশ। তাহলে কি ফের আসছে মৃত্যুদূত? নতুন বেশে? গতবার কিছু বোঝার আগে সে আক্রমণ হেনেছিল। মানুষ যখন ধরে নিয়েছিল, করোনা বিদায় নিয়েছে, তখনই আঘাত। এবার সরকার প্রস্তুত তো? রাজনীতির খেলায় আগে অবহেলার মাশুল দিয়েছে দেশবাসী। স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন করোনা বিদায় নিয়েছে, তারপরই তার রুদ্ররূপ।
এবার একই ভুল যেন না হয়। এক লকডাউনের ক্ষত এখনও শুকায়নি। ঘরের পথে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল দগদগে ঘা হয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, বেতন সংকোচনের প্রভাব অর্থনীতিতে। এক লকডাউন তছনছ করে দিয়েছে সমাজ। এই সময় আবার লকডাউন হলে ভেঙে পড়বে সব কিছু। একমাত্র সতর্কতা শৃঙ্খলা করোনাকে রুখতে পারে। ‘তৃতীয় ঢেউ’ (যদি আসে) রুখতে হবে লকডাউন না করেই।