অঞ্জন বসু: অসমে কি আবার সেই আটের দশকের সন্ত্রাস এবং বাঙালি-নিধনের দিনগুলি ফিরে আসছে?
উজান অসমের তিনসুকিয়া সংলগ্ন এলাকায় পাঁচজন বাঙালিকে গুলি করে খুন করার পর এই প্রশ্নই উঠে আসছে এখন। এই খুনের দায় কোনও সংগঠন নেয়নি। এমনকী, পরেশ বড়ুয়াপন্থী ‘আলফা’-ও এই হত্যালীলার দায় অস্বীকার করেছে। প্রশ্ন, তাহলে এই হত্যালীলা চালাল কারা?
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড যারা চালিয়েছে, তারা যে মূলত ‘বাঙালি-বিদ্বেষী’ এই বিষয়ে আশা করা যায় কেউই দ্বিমত পোষণ করবে না। কিন্তু এরা কারা, তা খুঁজে বের করা এখন জরুরি। আশা করা যায়, অসমের রাজ্য সরকার কালক্ষেপ না করে খুনিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করবে।
[৭২ ঘণ্টা আগেই পৌঁছায় সতর্কবার্তা, পুলিশি গাফিলতির ফল তিনসুকিয়া গণহত্যা!]
‘এনআরসি’ বা ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’ নিয়ে অসমে বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তেজক অবস্থা তৈরি হয়ে রয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে নতুন করে বাঙালি-অসমিয়া বিরোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টাও চলছে। ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে এই খসড়া তালিকা থেকে। এই নিয়ে একটা আতঙ্কের পরিবেশও সৃষ্টি হয়েছে। এই আতঙ্ক থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। তিনসুকিয়ায় খুনের পিছনে নতুন করে আরও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা চলছে কি না, তা খুঁজে দেখা দরকার। এই ঘটনা যে, সাধারণ খুনের ঘটনা নয়, কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নয়, তা সবাই স্বীকার করবেন বলেই আশা করা যায়। এই হত্যাকাণ্ডের মূল সম্ভবত অনেক গভীরে। সাধারণ বাঙালি-অসমিয়া দ্বন্দ্ব এটি নয়।
অসমে বাঙালি-অসমিয়া দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাঁচ-ছয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে যার সূচনা এবং তুঙ্গে ওঠে সাত-আটের দশকে। বহু রক্ত ঝরেছে এই দ্বন্দ্বে। নেলি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। কিন্তু গত দুই দশক ধরে পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে উঠেছিল। মানুষের জীবনযাত্রা বেশি স্বাভাবিক হয়েও উঠেছিল বলে মনে হয়। এই সময়ই আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’-র খসড়া তালিকা প্রকাশ। ৪০ লক্ষ মানুষ, তালিকায় যাদের নাম নেই, তারা কোথায় যাবে? কেউ স্পষ্ট করে জানে না।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বাস দিয়েছেন, অসম থেকে যারা উচ্ছেদ হয়ে আসবে, তিনি তাদের এই রাজ্যে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারে তিনি তার প্রস্তুতিও শুরু করতে বলেছেন। কিন্তু কত মানুষকে তিনি আশ্রয় দিতে পারবেন? ৪০ লক্ষ মানুষকে এই রাজ্যে জায়গা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। দিনের পর দিন ৩০/৪০ লক্ষ মানুষের ভরণপোষণও সরকারের পক্ষে প্রায় দুষ্কর। এদিকে বাংলাদেশও হাত ধুয়ে বসে আছে। তারা বলেই দিয়েছে, তাদের দেশ থেকে কোনও শরণার্থী ভারতে যায়নি। তাই কাউকে ফেরত নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তাহলে?
একটা জিনিস এখানে লক্ষ করার মতো– তা হল, তিনসুকিয়ায় যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা কিন্তু হিন্দু বাঙালি, মুসলমান নয়। তাই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলে এই হত্যাকাণ্ডকে চিহ্নিত করা যাবে না। অসমে এখন যে দল মসনদে, তাদের ঘোষিত নীতি হল, বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে যে হিন্দুরা এদেশে এসেছে, তাদের ‘শরণার্থী’ বলে আশ্রয় দেওয়া হবে, অন্যদের নয়। এই নীতির দিকে তাকালে মনে হয়, আর যাই হোক তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেখানকার শাসক দলের সংযোগ নেই। তা যদি নাই হয়, তবে রাজ্য সরকারকে কড়া হাতে এই জাতীয় ঘটনা দমন করতে হবে। খবরে বলা হয়েছে, এই সন্ত্রাস সম্পর্কে সাতদিন আগেই কেন্দ্র থেকে রাজ্যে সতর্কবার্তা এসেছিল। তারপরও কেন সতর্ক হয়নি রাজ্য, এই জবাবও তাদের দিতে হবে।
অসমে বাঙালিদের উপর কোনও অত্যাচার হলে প্রথমে আঙুল ওঠে আলফার দিকে। কিন্তু এখন আর সেই আলফা নেই। বেশ কয়েক বছর আগেই আলফার একটা অংশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের বলা হত ‘সালফা’-সারেন্ডারড আলফা। তারপরও অরবিন্দ রাজখোয়ারের নেতৃত্বে আরও একটা বড় অংশ আত্মসমর্পণ করে। বাকি থাকে শুধু পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন আলফা (স্বাধীন) বা আলফা-আই। সম্প্রতি কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলে অভিযোগ আসত পরেশ বড়ুয়ার আলফার দিকে। কিন্তু তিনসুকিয়ার ঘটনায় তাদের কোনও সংযোগ নেই বলে ঘোষণার পর প্রশ্ন ওঠে তাহলে কারা? আলফা থেকে কি তবে আরও নতুন কোনও গোষ্ঠী বেরিয়ে এল? যদি তা-ই হয়, তবে কিন্তু মারাত্মক। যে কোনও সময় তারা আবার কোনও মারাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে দেবে না তো?
হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়, অসমের সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে, কারা এত বড় একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল। এই ঘটনায় গোয়েন্দাবাহিনীর ব্যর্থতা প্রকট হয়ে পড়েছে। অসমে অবশ্য গোয়েন্দা-ব্যর্থতার একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে। নইলে অত ঘটনা ওই রাজ্যে ঘটতে পারে না। ছয়ের দশক থেকেই সেখানে নানা গোলমাল চলেছে। কোনওটাই রাজ্যের গোয়েন্দাবাহিনী আগাম আঁচ পায়নি। অসমে দীর্ঘ সময় কংগ্রেস রাজত্ব চলেছে। সেই রাজত্বে বারেবারে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, জাতিদাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই সরকার আগাম কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে। অথবা বলতে হয়, সরকার নীরব দর্শক হয়ে থেকেছে। বর্তমান সরকারের আমলেও যদি সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তা হবে খুবই দুঃখজনক।
আসলে ‘এনআরসি’ নিয়ে যখন এত উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে রয়েছে, তখন এমনিতেই সরকারের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল গোয়েন্দাবাহিনীকে আরও সক্রিয় করে তোলা। এখানেই অসম সরকারের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা ইচ্ছাকৃত কি না, তা অবশ্য বলা কঠিন। অসম বরাবরই খুব সংবেদনশীল রাজ্য। একটা বড় রাজ্য সাত টুকরো হওয়ার পরও দেখা গিয়েছে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই কোনও না কোনও কারণে সংবেদনশীলতা রয়েছে। অসম শাসন করা তাই খুব সহজ কাজ নয়। যেহেতু বিজেপি প্রথম এ রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে, তার পক্ষে তাই এই রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আরও কঠিন। বিশেষ করে ‘বিদেশি’ সংক্রান্ত বিষয়ে তো বটেই।
তিনসুকিয়ার ঘটনার বড় প্রভাব পড়বে সমগ্র অসমে। কারণ বাঙালিরা প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে বরাক উপত্যকায়। বরাক বাঙালি-অধ্যুষিত অঞ্চল। অসমের মধ্যেই যেন আর একটা বাংলা। তিনসুকিয়ার ঘটনার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে এবং পড়ছেও বরাক উপত্যকায়। অসম বন্ধের ডাক রাজ্যের নানা অঞ্চলে তেমন প্রভাব না ফেললেও বরাকে পূর্ণ বন্ধ হয়েছে। কারণ এই বন্ধ ছিল বাঙালি সংগঠনের ডাকা। ঘটনাস্থল তিনসুকিয়া, আর বরাকেই শুধু বন্ধের ডাকে সম্পূর্ণ সাড়া মিলেছে। অসমে বাঙালিদের উপর অত্যাচারের সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ঘটে বরাকে। সরকারকে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
অসমে বাঙালি নিধনের যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ঘটবে পশ্চিমবঙ্গে, সেটা একেবারে স্বাভাবিক। তাই দেখা গেল, তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ডের খবর আসা মাত্র বিজেপি বাদে সমস্ত রাজনৈতিক দল পথে নেমে পড়েছে। সবার প্রতিবাদের ভাষা মোটামুটি একই। অসমে যেহেতু বিজেপি সরকার রয়েছে তাই তাদের পক্ষে এই ঘটনার প্রতিবাদের পথে কিঞ্চিৎ অসুবিধা। এছাড়া দেখা গিয়েছে ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’-র ব্যাপারেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভিন্ন সুর। তারা পরিষ্কারভাবেই বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলেও তারা এখানে নাগরিকপঞ্জির ব্যবস্থা করবে। এদের বাদ রেখে তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস এক সুরেই কথা বলছে। নাগরিকপঞ্জি থেকে তিনসুকিয়া হত্যাকাণ্ড-সব বিষয়েই তারা সহমত পোষণ করছে।
এই ব্যাপারে অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস অনেকটা এগিয়ে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যেমন শিলচরে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল, একইরকমভাবে তিনসুকিয়াতেও তারা ঘটনার খোঁজখবর নিতে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। শিলচরে ওই প্রতিনিধি দলকে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। বিমানবন্দর থেকে তাদের ফিরে আসতে হয়েছিল। তিনসুকিয়ায় অবশ্য তেমন ঘটনা ঘটেনি। বিজেপি সরকার এবার ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছে। দেখতে হবে, রাজনৈতিক অতিসক্রিয়তার জন্য অসমে যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না ঘটে। অসমে বাঙালিরা যেন শান্তিতে থাকতে পারে।
[তিনসুকিয়া গণহত্যা: নিহতদের পরিবারকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হচ্ছে তৃণমূল]
The post অসমে কি ফিরছে বাঙালি-নিধনের দিনগুলি? appeared first on Sangbad Pratidin.