সুকুমার সরকার, ঢাকা: করোনা মহামারীর আবহে ম্লান অমর একুশের উদযাপন। এবার সীমিত পরিসরে প্রভাতফেরি করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সংক্রমণ রুখতে মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কার্যক্রম কাটছাঁট করা হয়েছে।
[আরও পড়ুন: তিন স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ বাংলাদেশে, এক বছর পর অভিযুক্ত ১০ জনের বিরুদ্ধে পেশ চার্জশিট]
জানা গিয়েছে, করোনা বিধি মেনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহম্মদ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে প্রভাতফেরিতে অংশ নেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অন্য কর্মীরা। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, “করোনা পরিস্থিতিতে জনসমাগম এড়াতে এই বছর কোনও সংগঠনের পাঁচজন সদস্য এবং সর্বোচ্চ দু’জন ব্যক্তি একসঙ্গে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বেদিতে ফুল দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সবাইকে অবশ্যই যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে ও মাস্ক পরতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পলাশী মোড় থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত রাস্তায় তিন ফুটের ব্যবধানে পরপর চিহ্ন থাকবে। এই চিহ্ন অনুসরণ করে সবাই পর্যায়ক্রমে শহিদ মিনারে যাবেন এবং ফুল দেবেন। এই ক্ষেত্রে যথাযথ রুট ম্যাপ অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রবেশপথে স্বেচ্ছাসেবকেরা মাইক দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে প্রচার চালাবেন।”
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। একুশের আন্দোলনের বীজের মধ্যে অঙ্কুরিত ছিল বাঙালির স্বাধীনতার মন্ত্র। একুশের মধ্য দিয়ে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম। সে এক মহা ইতিহাস। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এসে দেশটির গভর্নর মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকার রেসকোর্সের (বর্তমানে সুরাওয়ার্দি উদ্যান) জনসভায় এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র জনতার মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাংলাকে দেশের সিংহভাগ নাগরিকের ভাষা উল্লেখ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান। সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও জানান তিনি। তাঁর এই বক্তব্য সমর্থন করেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য। বাঙালি জনসাধারণ তাঁদের মাতৃভাষার দাবি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবি নিয়ে ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে পড়ে।
ভাষা আন্দোলন দমাতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সকল সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু বীর বাঙালি তা মানবে কেন। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সাধারণ মানুষকে নিয়ে মিছিল বের করেন। আন্দোলন দমাতে তৎকালীন পাকিস্তানের পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক, শফিক-সহ নাম না জানা অনেকে। প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে মহা ইতিহাস গড়েন তাঁরা। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পড়ুয়াদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। ফলে বাঙালির ভাষা আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফূরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগায়।