কিংশুক প্রামাণিক: বিধানসভা ভোটে এবার বাংলায় লড়াই সরাসরি। তৃণমূল বনাম বিজেপি। হয় তৃণমূ্লই ফিরবে, তারা না পারলে বিজেপির স্বপ্ন সফল হতে পারে। এর বাইরে কিছু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
[আরও পড়ুন: ‘কৃষকরা নিজেরাই জানেন না তাঁরা কী চান’, বিজেপি সাংসদ হেমা মালিনীর মন্তব্যে বিতর্ক]
বহুমুখী রঙ্গের বঙ্গ-ভোটে তৃতীয় পক্ষ বাম-কংগ্রেস জোট। বাংলায় দুই পক্ষের শক্তি তলানিতে এলেও গুরুত্বের বিচারে তাদের খাটো করে দেখা যাবে না। দু’-দশক আগেও বাংলায় ‘কংগ্রেস বনাম সিপিএম’– এই ছিল বাঙালির সকাল-বিকেল, গীতা-কোরান, ’৭২-এর সন্ত্রাস বনাম ধানতলা-বানতলা। বামেরা ৩৪ বছর টানা ক্ষমতা ভোগ করেছে। দীর্ঘ প্রায় ২৩ বছরের বেশি জ্যোতি বসুর পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সাড়ে ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রিত্ব করেছেন। অন্যদিকে ’৭৭ সালে বামফ্রন্ট আসার আগে দু’দফায় যুক্তফ্রন্টের কয়েকটা বছর বাদ দিলে প্রায় ২৫ বছর বাংলার মসনদে ছিল কংগ্রেস। ডা. বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, সিদ্ধার্থশংকর রায়ের মতো দিকপালরা মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে তৃণমূল উত্থানের পর সব অনুপাত ওলটপালট হয়। বামেদের প্রধান চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে পরিবর্তনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হন। দশ বছর তিনি ক্ষমতায়। সামনে তঁার হ্যাটট্রিকের চ্যালেঞ্জ।
এবার তৃণমূল-বিজেপির লড়াই স্পষ্ট। প্রশ্ন হল, ‘তৃতীয় পক্ষ’ অর্থাৎ বাম-কংগ্রেস জোট ক’টা অাসন পেতে পারে? না কি লোকসভার চেয়ে খারাপ ফল হবে? কোনওভাবে কি এবার ‘ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতি’ দেখা দিতে পারে? সেক্ষেত্রে সামান্য কিছু আসন পেলেও সরকার গড়ার অনুঘটক কি হতে পারে জোট? এসব জল্পনা ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবে। রাজনীতিতে কোনও কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দশ বছর আগেও কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, ২০০৬ সালে ২৩৫ পাওয়া বামফ্রন্টের প্রধান শক্তি সিপিএমকে আসন জেতার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে কংগ্রেসের হাত ধরতে হবে? অর্থাৎ অনিশ্চয়তার অপর নামও রাজনীতি। সেখানে জল আজ যে ঘাটে স্বচ্ছ, কাল সেই ঘাটেই ঘোলা হয়ে উঠতে পারে। ভোটে কী হবে, তা আগাম বলে দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু অঙ্ক একটা থাকেই। যা দেখেই সম্ভাবনা বিচার হয়। এবার যেমন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সরকার গড়ার লড়াই সরাসরি তৃণমূল বনাম বিজেপির।
কেন সরাসরি এই বিভাজন? গত পাঁচ বছর বাংলার মানুষের ভোট দেওয়ার প্রবণতা বিচার করলেই সবটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস জোটের সম্ভাবনা নিয়ে বিরাট প্রচার শুরু হয়। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন তৃণমূল হারছে। জোট ক্ষমতায় আসবে। বিজেপি কোনও আলোচনাতেও ছিল না। ভোটবাক্স খুললে দেখা যায়, প্রায় ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ২১১ আসন দখল করেছে তৃণমূল। কংগ্রেস পেয়েছে ৪৪ আসন। আগেরবার ছিল ৪৬। বামফ্রন্ট ৪০ থেকে কমে ২৬। বিজেপি শূন্য থেকে তিন। শতাংশের বিচারে বামফ্রন্ট পায় ১৯.৭৫ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পায় ১২.২৫ শতাংশ। বিজেপি ১০.১৬ শতাংশ। তৃণমূলের পক্ষে মানুষের রায় ছিল স্পষ্ট। এই ছবি একই সঙ্গে বলে দেয় বিরোধী ভোট ত্রিধাবিভক্ত হওয়ার জন্য তৃণমূলের আসন ২০১১ সালের চেয়েও বেড়েছে। তিন বছর পর ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে কিন্তু বিরোধী শিবিরের ভোট সমীকরণের চিত্রটা আমূল বদলে যায়। ধাক্কা খেয়ে মাত্র তিন শতাংশ ভোটে হারালেও এক নম্বর দলের মর্যাদা থাকে শাসক তৃণমূলের হাতে। যদিও লোকসভা আসন ৩৪ থেকে কমে ২২-এ নামে।
তবে বিরোধী ভোটের ছবিটা পুরো বদলে যায়। বাম ও কংগ্রেসের ফল হয় শোচনীয়। বামেরা কোনও আসন না পেয়ে ভোট পায় মাত্র ৬.৩৩ শতাংশ। দু’টি আসন জিতে কংগ্রেস পায় ৫.৬৭ শতাংশ। কোনও কোনও লোকসভায় বামেদের ভোট আড়াই-তিন শতাংশেও নেমে যায়। জোট ছিল না। কিন্তু দুই দলের মিলিত ৩২ শতাংশ ভোট নামে ১২ শতাংশে। অর্থাৎ বিধানসভা নির্বাচনে পাওয়া ভোটের প্রায় ২০ শতাংশ তারা হারিয়ে ফেলে লোকসভা ভোটে। লাভ হয় বিজেপির। তারা দশ শতাংশ থেকে পৌঁছে যায় ৪০.৭ শতাংশে। ফলশ্রুতিতে ১৮টি লোকসভা আসনে জয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালে বিরোধী ভোট ছত্রখান হওয়ার সুবিধা পায় তৃণমূল। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী ভোট বিজেপির দিকে ঢলে যাওয়ায় অনেকগুলি আসন হারাতে হয় শাসক দলকে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের মজা এমনই! বিজেপি দেশের শাসক। সাড়ে তিনশো আসন নিয়ে ক্ষমতায় এনডিএ। বিজেপি একাই সেখানে ৩০৩। যদিও অঙ্ক একই সঙ্গে বলছে, দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ তাদের ভোট দেয়নি। একইভাবে একক বৃহত্তম দল হয়েও বিহারে বিরোধী আসনে তেজস্বী যাদব। তৃতীয় হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে নীতীশ কুমার। বাধ্যবাধকতার জটিল সমীকরণে বিজেপি এগিয়েও মুখমন্ত্রীর পদ নিতে পারেনি। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের বিন্যাস পুরো আলাদা। লোকসভায় যা হয়েছে বিধানসভায় তা হবে মনে করার কারণ নেই। লোকসভা স্থায়িত্ব ও বিরোধীদের কাছে নরেন্দ্র মোদির ‘বিকল্প মুখ’ না থাকার সুযোগ নিয়েছে বিজেপি। বিরোধীদের উড়িয়ে একচ্ছত্রভাবে জিতেছে। পুলওয়ামা কাণ্ডের পর জাতীয়তাবাদের হাওয়া তাদের পক্ষে গিয়েছে।
স্বভাবতই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলায় বিধানসভা ভোটের ফল লোকসভার সরণি মেনে হবে না। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ও সরকার গড়ার পক্ষে প্রচার চালিয়ে বিজেপি ফায়দা তুলতে চাইবে। অাবার তৃণমূল বিরোধী ভোটে থাবা বসাতে তৎপরতা দেখাবে বাম-কংগ্রেস। সেটা বিজেপিকে চিন্তায় রাখবে। মমতাও পাবেন তাঁর কাজের পক্ষে ইতিবাচক ভোট। এই সমীকরণে ভোটারের চরিত্র বদল হবেই। যিনি লোকসভায় মোদিকে ভোট দিয়েছেন, তিনি এবার দিদিকে দিতেই পারেন। অনেক ফ্যাক্টর, দলবদল, নানা ইস্যু থাকবে রাজ্যের ভোটে। ফায়দা নিতে তৎপর থাকবে শাসক ও বিরোধী– সব পক্ষই।
তবে এবারের ভোটে বিজেপির উত্থানে ধর্মনিরপেক্ষ ভোটে ভাঙন অনেকটাই কমবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজেপিকে হারাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভোটের বড় অংশ পড়বে তৃণমূলের বাক্সে। এক সময় এই ভোট একচেটিয়া বাম ও কংগ্রেস পেত। একইভাবে সংখ্যালঘুদের ভূমিকা এবার খুবই উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে মিম, আব্বাস সিদ্দিকির নতুন দল, মুসলিম ভোট কুড়োতে ভোটে নামছে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা কি তাদের পক্ষে যাবেন? লোকসভা ভোট থেকে মুসলিম ভোট তৃণমূলের পক্ষে সংগঠিত হচ্ছে। এই ভোটে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট বিরাট ফ্যাক্টর। বাম-কংগ্রেসের মুসলিম গড়ে তৃণমূল ঢুকে পড়ায় তাদের ভোট পার্সেন্টেজ অনেকটা কমে গিয়েছে।
বাম দলগুলি ও কংগ্রেস খানিকটা উভয় সংকটে। তারা যেমন চায় না বিজেপি ক্ষমতায় আসুক, তেমনই আরও পাঁচ বছর তৃণমূলের শাসন মেনে নেওয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব। সেই প্রেক্ষিতে বাম-কংগ্রেস নেতাদের একাংশ মনে করেন, বিজেপি আসে আসুক, তৃণমূল আগে যাক। তাদের অঙ্ক অদ্ভুত। তৃণমূল হেরে গেলে নাকি তলিয়ে যাবে। সেই সুযোগে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ব্যাটন আবার হাতে নিয়ে বিজেপির বিকল্প হয়ে উঠবে তারাই। তাই নিচুতলায় স্লোগানও দেওয়া হচ্ছে, ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম’। তাই কি হয়? রাজনীতি হল এমন একটি বিষয় তা কখনও কারও ভাবনায় আবদ্ধ নয়। কখনও নিজের তৈরি খাতেও পরিচালিত হয় না। সংসদীয় ব্যবস্থায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন জনগণ। তাই কে থাকবেন, কে যাবেন, কে ভোট পাবেন, অথবা পাবেন না, তা চূড়ান্ত হয় জন-রায়েই। ‘জনসমর্থন’ কথাটার গুরুত্ব তাই এত গুরুত্বপূর্ণ। তাতেই নিহিত একুশের সব অঙ্ক।