কিংশুক প্রামাণিক: আশ্বিনের শারদপ্রাতে সুদূর কৈলাস থেকে মা আনন্দময়ীর হাত ধরে ধরাধামে আসতে একমাস বাকি। তার আগে ভাদ্রের শুক্লা চতুর্থীতে বরাবর একাই এক দফা মর্ত্যে ঘুরে যান গণপতি। এবারও তার অন্যথা হচ্ছে না। এসে গেলেন গণেশ ঠাকুর।
জন্মোৎসবের এই আগমন এতদিন ছিল মূলত আরব সাগরপার অথবা হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে। বাংলার গণেশকাল অন্য। কিন্তু আজ সব উলটোপালটা। তাই বঙ্গের পূজা ক্যালেন্ডারে আচমকা গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে মহারাষ্ট্রের গণপতি বাপ্পা। গণেশ চতুর্থী এখন কোচবিহার থেকে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়। মহা সমারোহে। গণেশের জনপ্রিয়তা তাঁর দেবমাহাত্ম্যে শুধু নয়, নধর চেহারা, হাতির মাথা, শুঁড়-সবই তাঁকে বাঙালির হদয়ে কোমল জায়গা করে দিয়েছে। উপাচারে বারোমাস্যায় গণেশ চতুর্থী নামক নতুন একটি পরব জুড়ে যাওয়ায় বেশ উপভোগ করছে সবাই।
বাঙালি ধর্মপ্রাণ, উৎসব পাগল। আচার-উপাচার-লোকাচার বঙ্গের ঘরে ঘরে। কখনও গোঁড়ামি নয়। বাঙালি ধর্ম পালনে উদার। ধর্মাচরণ এই রাজে্য আনন্দবার্তার মতো। যেন এক মিলনমেলা। দুর্গাপুজো, ইদ, বড়দিন, সবেতেই উৎসবমুখর মানুষ। কেউ জানতে চায় না, তুমি হিন্দু না মুসলমান, শিখ না খ্রিস্টান। সারা বছর তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পুজো হয় এই বাংলায়।
মানুষের বিপদ-আপদ, সমস্যা, প্রত্যাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষার সমাধানে নির্দিষ্ট আছেন এক-এক জন দেব অথবা দেবী। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে তাঁরাই সব বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন বলে বিশ্বাস। লোকগাথা হল- সবার মধ্যে গণেশ মহাশয় খুব পাওয়ারফুল। যে কোনও শুভ কাজের সূচনায় গণেশবন্দনা তাই দস্তুর। বাঙালির ব্যাবসাঘরে সিদ্ধিদাতারূপে বছরভর তিনি পূজিত হন। পয়লা বৈশাখ হালখাতার দিন মহাসমারোহে তাঁর মৃন্ময়মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই অর্থে বুদ্ধি, ঋদ্ধি ও সিদ্ধির এই দেব বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়েই আছেন। বড় আদর তাঁর। ধর্ম যখন সাধারণ মানুষের হাতে থাকে তখন তার রূপ উত্তম। কিন্তু ধর্মকে যখন রাজনীতি গ্রাস করে তখন তার রূপ ভয়ংকর। ইতিহাস সেই সত্য বলে। ভারতের সনাতন ঐতিহে্যর হিন্দু মন্দির স্মারকগুলিকে ধ্বংস করতে কালাপাহাড়ের অভিযান অথবা তালিবানি ফতোয়ায় বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির গুঁড়িয়ে যাওয়া অথবা বাবরি মসজিদ ধুলোয় মেশা- সবই ধর্মের রাজনীতি, এক কদর্য রূপ। এ খেলা আগুন নিয়ে। যে আগুন দাবানলের মতো। পুড়িয়ে দিতে পারে সব। অর্থাৎ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বিভেদ তৈরি করে। সমাজে বিভাজন স্পষ্ট করে দেয়।
একদা আমরা সবাই দেখেছিলাম, রাজনীতির গণেশ কতটা শক্তিশালী। তাঁর অলীক ‘দুগ্ধসেবন’ গোটা দেশে সহসা সত্যযুগ ফিরিয়ে এনেছিল। সব কাজ ফেলে গণেশকে দুধ খাওয়াতে নিজের নাওয়া-খাওয়া ডকে তোলে মানুষ। ধর্মের সেই আফিম ঘোরে কে নেই দৌড়ে! দেখেছিলাম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই দৌড়চ্ছেন বিনায়ক মহাশয়ের ঘরে। ঈশ্বর হাত থেকে দুধ খাবেন, চাট্টিখানি কথা নাকি। হায় রে ভারত! যে দেশে লক্ষ লক্ষ শিশু গরুর দুধ না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে, সেই দেশের নর্দমা ভেসে যায় কোটি কোটি গ্যালন দুগ্ধপ্রবাহে। অচিরেই বুজরুকি ধরা পড়ে। বিজ্ঞান প্রমাণ করে দেয় আসল রহস্য। মানুষের কি তাতে ঘোর কাটে? নাহ।
গঙ্গাপারে আচমকা গণেশ চতুর্থীর হিড়িক সেই রাজনীতির অঙ্গ, সে কথা বলছি না। কিন্তু ইদানীং এই কালচার-ই আমদানি করা হচ্ছে সচেতনভাবেই। কলকাতা তথা রাজে্য বহু হিন্দিভাষী মানুষ বাস করেন। তাঁরা তাঁদের পুজো-অর্চনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মহা সমারোহে পালন করেন। বাঙালিরাও সেই উৎসবে যোগ দেন। এর মধে্য কোনও বিরোধ নেই। আগে কখনও হিন্দি সংস্কৃতির ঝাপট বাংলার পরম্পরা-ঐতিহ্যের মধ্যে ঢুকে পড়েনি। এখন সেটাই হচ্ছে। গোবলয়ের ধাঁচে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী পালনের ঘটা তার প্রমাণ। তাও পালনটা উৎসবমুখর হলে ঠিক ছিল। রাজনীতির লোকজনের অস্ত্র হাতে হুংকার-মিছিল বুঝিয়ে দেয়, কোন মিছিলের পালটা এইটি। কেন এই ঢাল-তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে। যাই হোক, বিভেদের এই রাজনীতি থেকে বাংলা সরে থাকতে পারবে, এমনই আশা করা যেতে পারে। যাঁরা করছেন তাঁদের বুঝতে হবে, রামনবমী বাংলায় স্বাগত। কিন্তু বাংলা কখনও উত্তরপ্রদেশ হতে পারে না।
‘গণেশ’ নামটি কতটা ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে তার উদাহরণ হল, কারও যদি ব্যাবসা গুটিয়ে যায় আমরা বলি: গণেশ উলটে গিয়েছেন। অর্থাৎ গণেশ হলেন সৌভাগ্য ও সাফল্যের প্রতীক। তিনি আছেন তো সিদ্ধিও আছে। তিনি নেই মানেই লালবাতি। তাই মনে হয়, প্রাক-শারদ মরশুমে সিদ্ধিদাতা গণেশের এই আবাহন যদি ‘রাজনীতিমুক্ত’ থাকে তার চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না। আরও মনে হয়, অনেক তো হল, আমাদের দেশও এখন এমনই একজন গণেশ চায়। যাঁর মিডাস টাচ-এ দেশ তরতরিয়ে এগোবে। মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে। ধর্ম নয়, মনুষ্যত্বই হবে ভারতবাসীর পরিচয়। সবার ঘরে শিক্ষা, সবার ঘরে অালো। সবার জন্য কাজ। মাথা উঁচু হবে দেশের। সতি্য যার নাম ‘রামরাজ্য’।
খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। বিশ্ব দরবারে দেশের গুরুত্ব কমেছে। পড়শিদের সঙ্গে অশান্তি অবিরত। সামাজিক বিভাজন সংকট তৈরি করছে। ধনী-দরিদ্রের দূরত্ব স্বাধীনতার ৭১ বছরে দাঁড়িয়ে সীমাহীন। ভাবা যায়, ৮৩ টাকা পেট্রোল আর ৭৫ টাকা ডিজেল! প্রতিদিন দাম বেড়েই চলেছে। কারও হুঁশ নেই। কেরোসিন, রান্নার গ্যাস মহার্ঘ। নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। টাকার পতন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। এরপরও কী করে দিন ‘অচ্ছে’ হয় কে জানে! সাধারণ মানুষের দুর্দশা কি যাঁরা দেশ চালান, তাঁদের চোখে পড়ে না? দেশে দারিদ্র, বেকারত্ব হু হু করে বাড়ছে। কাজ হারাচ্ছে কৃষক-শ্রমিক। এই কি রাম রাজত্ব! শাসক অবশ্য বলছেন, সব ঠিক আছে। দেশ এগিয়ে চলেছে। এত ভাল সব কিছু হচ্ছে যে আগামী ৫০ বছর হেসে-খেলে ক্ষমতায় থাকবেন তাঁরাই।
বিরোধী শিবির কতটা শাসককে আঘাত করতে প্রস্তুত? প্রশ্নটা থেকে যায়। তাদের একতার অভাবে শাসক শক্তি বাড়িয়েছে। হঠাৎ বন্ধ-বিরোধী শিবিরের বিভাজন স্পষ্ট। যে ইসু্যতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছিল, সেই ইসু্যতেই বন্ধ ডাকা হয়। বাংলায় নিজেদের দলের গণেশ উলটে যাওয়া দু’-তিনটি দল বন্ধ ডাকে। কিন্তু মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করল। রাজ্য স্বাভাবিক থাকল। রাজে্যর শাসকদল ইসু্যর পক্ষে। কিন্তু বন্ধ-বিরোধী। তাদের বক্তব্য ছিল, বন্ধ করে কী হবে? ওটা শেষ পথ। ঠিক কথা। বন্ধের পরও তো দাম বাড়ল। তাহলে কি আবার বন্ধ হবে? বাকি দু’টি দল বুঝল না। তাদের কর্মনাশায় জেদ। মানুষও পালটা দিল। তবে একটা জিনিস খুব ভাল হয়েছে। বাংলায় বন্ধ রাজনীতির গণেশ কিন্তু উলটে গেল। আর কেউ এ রাজ্যে বন্ধ ডাকবে না। যাই হোক, বিনায়ক মহাশয়ের আগমন মহা আনন্দে পালিত হোক। তিনিই সিদ্ধিদান করবেন সুসময়ের। সবাই মিলে আসুন বলি: ওম্ গণপতয়ে নমঃ।
The post বিনায়কের মতো নায়ক appeared first on Sangbad Pratidin.