সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে ঘাটে ফিরছিলেন। প্রবল দুর্যোগের মধ্যে পড়ে হঠাৎই বিকল হয়ে যায় যন্ত্রচালিত নৌকা। তখন রাত সাড়ে আটটা। কাঁসাইয়ের মাঝ নদীতে বৃষ্টি এল ঝেঁপে। সঙ্গে দমকা হাওয়া। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরসা শুধু দু’টি টর্চ। কিন্তু বৃষ্টির জল ঢুকে তারও আলো নিভেছে। অবিরাম বৃষ্টিতে নৌকাতেও জল জমতে শুরু করেছে। সেই জল ফেলারও সুযোগ পাচ্ছেন না দুই মাঝি। কাঁসাই–কুমারী সঙ্গমস্থলে তখন নৌকা ডুবুডুবু। ভাসতে ভাসতেই বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর থেকে পুরুলিয়ার ঘাটে এসে উঠলেন মাঝিরা। প্রকৃতির রোষের সঙ্গে টানা ১১ ঘণ্টার যুদ্ধে অবশেষে তাঁরাই জয়ী হলেন।
শুক্রবারে পুরুলিয়ার বোরোর আমজোড়া ঘাট থেকে নিথর অবস্থায় স্থানীয়রা নৌকার মালিক গৌতম বাগদিকে উদ্ধার করেন। কিন্তু জল জমে যাওয়া নৌকায় গৌতমকে ওই অবস্থায় দেখে চমকে উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গী সুনীল বাগদি। তাই প্রথম দিকে অজানা আশঙ্কায় পালিয়ে যান তিনি। ভাবেন, সঙ্গী বোধহয় প্রাণহীন!কিন্তু নৌকার মালিক গৌতমকে আমজোড়া গ্রামের বাসিন্দারা উদ্ধার করেন। আগুন জ্বালিয়ে, তাপ দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। জ্ঞান ফিরলে তাঁর জন্য ভরপেট খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে বোরো থানার পুলিশ ওই অসুস্থ মাঝিকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেয়। বছর পঁয়ত্রিশের মাঝি গৌতমের কথায়, “এখনও যে বেঁচে আছি, সেটা ভাবলেই যেন অবাক লাগছে। যখন দমকা হাওয়ায় ঝেঁপে বৃষ্টি এল, টর্চগুলো বন্ধ হয়ে গেল, নৌকাতে জল জমতে লাগল। তারপর থেকে আর কিছু মনে নেই।”
[আরও পড়ুন: পরিত্যক্ত কুয়োয় পড়ে গুরুতর আহত হাতি, ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে উদ্ধারের পরিকল্পনা]
কাঁসাই–কুমারী নদীর ওপর মুকুটমনিপুর জলাধারের এক পাড়ে বাঁকুড়া। আরেক পাড়ে পুরুলিয়া। নিম্নচাপের এই দুর্যোগে বৃহস্পতিবার সন্ধে নাগাদ মুকুটমনিপুর জলাধারের পরেশনাথ ঘাটে নৌকা বেঁধে বাড়ি ফিরছিলেন রানিবাঁধ থানা এলাকার বাসিন্দা দুই মাঝি। তখনই এই মুকুটমনিপুর জলাধারের বনপুকুরিয়া ঘাটের একদল যাত্রী রোগীকে নিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। ওই যাত্রীদের সঙ্গে রোগী থাকায় এই প্রবল দুর্যোগেও সে কথা ফেলতে পারেননি মাঝিরা। নির্দিষ্ট ঘাটে তাঁদের ছেড়ে ফেরার পথেই এই বিপদের মুখে পড়েন। তারপর সে এক লড়াই!
আমজোড়া গ্রামের উদ্ধারকারী রাজীব সিং, বিশ্বনাথ মাহাতো বলেন, “ওই নৌকা মাঝনদী থেকে জলপথে প্রায় দশ কিলোমিটারেরও বেশি ভাসতে ভাসতে চলে আসে। সকালবেলা হঠাৎই নৌকার মধ্যে নিথর মাঝিকে দেখে আমরা হতবাক হয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে উদ্ধার করে হাত,পা ঘসে আগুনের তাপ দিই।” এদিকে ওইদিন রাতে দুই মাঝি বাড়ি না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। সকালে পরেশনাথ ঘাটে থাকা ১৪টি নৌকার মধ্যে একটি অনুপস্থিত দেখে উদ্বেগ বাড়ে। তখনই মাঝনদীতে ১১ ঘন্টার হাড়হিম করা ঘটনা সামনে আসে।
[আরও পড়ুন: মিলল সাতরকম আত্মার হদিশ, সিউড়িতে ভূত খুঁজতে গিয়ে তাজ্জব গবেষকরা]
পরেশনাথ গ্রামের বাসিন্দা তথা পুড্ডি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান টুম্পা বাগদির স্বামী সমীর বাগদি ওই অসুস্থ মাঝিকে নিয়ে যেতে আমজোড়ায় এসে বলেন, “আমরা সারারাত ওদের দু’জনকে খুঁজে বেরিয়েছি। তারপর খবর পেতেই সড়কপথে একুশ কিলোমিটার পথ ভেঙে এখানে আসি। সত্যিই দু’জন বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছেন।” একেই বোধহয় বলে – “রাখে হরি, মারে কে!”
ছবি: অমিত সিং দেও।
The post মাঝনদীতে তুমুল বিপর্যয়, ১১ ঘণ্টা লড়াই করে মৃত্যুঞ্জয়ী দুই মাঝি appeared first on Sangbad Pratidin.
