বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: আধুনিকতা গিলে খেয়েছে 'চৈতের পন্তা' বৈশাখে খাওয়ার রীতি। উত্তরের রাজবংশী সমাজ বছরের শুরুতে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি 'তিতা জল' পানের প্রথাও প্রায় ছেড়েছে। বেমালুম ভুলেছে 'কান্দির জল' প্রস্তুতের কথা। সংক্রান্তিতে প্রত্যন্ত গ্রাম ছাড়া দেখা মেলেনি তুলসীতলায় ঝোরা বাধা। গ্রামীণ নতুন প্রজন্ম নতুন পোশাকে হইচই, রেস্তোরাঁয় বসে ভুড়িভোজেই নববর্ষ পালনে অভ্যস্ত এখন।

কয়েক দশক আগেও উত্তরের তিস্তা, তোরসা, মানসাই পাড়ের নববর্ষ উৎসব বলতে আর দশটা উৎসবের মতো নিছকই হই-হুল্লোড় ছিল না। সেখানে জড়িয়ে ছিল কৃষি বন্দনার আকুতি। সমাজের প্রতিটি মানুষকে বছরভর নিরোগ রাখার চিন্তা। প্রকৃতি প্রেম ও সর্বপ্রাণবাদের ভাবনা। নববর্ষে নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয়ে যেত একের পর এক রীতি পালনের পর্ব। দিনের শুরু হতো চালভাজা, পাটবীজ, নিমপাতা-সহ বিভিন্ন ভেষজ গুণসম্পন্ন সামগ্রী দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি 'তিতা জল' পান করে। এরপর থাকত 'চৈতের পন্তা বৈশাখে খাওয়া'-র রীতি পালন। রাজবংশী সমাজে চৈত্র সংক্রান্তি পরিচিত 'বিষুয়া সংক্রান্তি' নামে। সংক্রান্তির রাতে রান্না করা ভাতে জল ঢেলে রেখে পরদিন পান্তা তৈরি করে খেয়ে নিতেন প্রত্যেকে। সেটাই 'চৈতের পন্তা বৈশাখে খাওয়া'-র রীতি নামে পরিচিত।
বিশেষ পদ্ধতিতে গরম ভাতে ঢেলে দেওয়া জল তুলে 'কান্দির জল' সংরক্ষণ করা হত। বিষুয়া সংক্রান্তির রাতে সেই প্রস্তুতি চলত। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল কান্দির জল বজ্রপাত থেকে রক্ষা করত। প্রবীণ রাজবংশী গবেষক তথা রাজবংশী ভাষায় প্রকাশিত 'উজানী' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নরেশচন্দ্র রায় বলেন, "নববর্ষের প্রতিটি মেনু ছিল ভেষজ গুণসম্পন্ন। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে অনেক ভাবনা-চিন্তা করে ওই খাবারগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে এখন সবই মুছে যেতে বসেছে। চালু হয়েছে ফার্স্ট ফুড। হই-হুল্লোড়।" খুব একটা মন্দ বলেননি নরেশচন্দ্রবাবু। নতুন প্রজন্ম জানেই না নববর্ষে চিড়ে, মটর, ছোলা সহ আট কলাই, পিয়াজ, রসুন, আদা, লঙ্কা, কাচা আম দিয়ে মাখা 'দো-ভাজা' নামে পরিচিত বিশেষ রেসিপির কথা।
পেশায় কৃষক বিশ্বনাথ রায় বলেন, "তিন দশক আগেও বৈশাখের শুরুতে গ্রামে হাল যাত্রা হত।" বিষুয়া সংক্রান্তিতে ঝোরা বাধা হত তুলসীথানে। বেশি ফলনের আশায় প্রতিটি গাছের গোড়ায় দেওয়া হত বিষ মাটি নামে পরিচিত সাধারণ মাটি। খড়ের বেড়ি দিয়ে গাছে বাধা হত বিষবাণ। নববর্ষে বৃক্ষ রোপণের প্রথা প্রচলিত ছিল রাজবংশী সমাজে। ছিল মেচেনী অর্থাৎ তিস্তাবুড়ি জাগাতে 'ফটামারা পর্ব'। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক রায় বলেন, "উত্তরের রাজবংশী সমাজে বিষুয়া সংক্রান্তি থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান শুরু হত। সবটাই ছিল কৃষিকেন্দ্রিক। এখন ওসব বিলুপ্তপ্রায়।"
কেন হবে না?
শহরে নববর্ষ এখন বিজনেস ব্র্যান্ড। বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে ফ্যাশন হাউস প্রত্যেকে বিপণনে সক্রিয়। সেই ধাক্কা আছড়ে পড়ছে গ্রামের শরীরে। তাই প্রাণ হারাচ্ছে লোকসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। গবেষকদের একাংশ মনে করছেন নববর্ষ উৎসব ক্রমশ প্রাণ হারিয়ে ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। যার পরিণতিতে বিলুপ্ত হতে বসেছে উত্তরের রাজবংশী সমাজে প্রচলিত মূল্যবান রীতি, প্রথা, খাদ্যাভ্যাস।