সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ১ হাজার, ২ হাজার পৃষ্ঠা নয়। প্রায় ১২ হাজার পৃষ্ঠা। যার পংক্তিতে, পংক্তিতে তথ্যে ভরা। কোন লাইনে নতুন পরিকল্পনা, কোন লাইনে সংগঠন বৃদ্ধির কৌশল, কোন পংক্তিতে ‘মাস কিলিং’ বনাম গণ আন্দোলন, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়ের মতো তাদের সাংগঠনিক শক্তিশালী রাজ্যে যৌথ বাহিনীকে (Joint Force) পালটা আঘাতের ছক! পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শুধুই সমাজ বদলানোর স্বপ্নে সরকার বিরোধী খতিয়ান। আর ধৃত মাওবাদী নেতা (Maoist leader) সব্যসাচী ওরফে ‘কিশোরদা’র থেকে উদ্ধার হওয়া সেই হাজার-হাজার নথি চোখ বুলিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কালঘাম ছুটছে রাজ্য পুলিশ, এনআইএ-সহ (NIA) অন্যান্য রাজ্যের পুলিশ মিলিয়ে ডজন খানেক এজেন্সির। বিনিদ্র রজনী কাটছে ওই এজেন্সিগুলির পুলিশ অফিসার থেকে পুরুলিয়া পুলিশ সুপারেরও। আসলে বিপুল ওই নথির তথ্যই যে দেশের মাও দমনে বড় অস্ত্র!
চলতি মাসের ১১ জানুয়ারি পুরুলিয়ার (Purulia) অযোধ্যা পাহাড়তলির বাঘমুন্ডির মাঠা বনাঞ্চলের ঝাড়খণ্ড লাগোয়া চাউনিয়া গ্রাম থেকে সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটি, ইস্টার্ন রিজিওনাল বুরোর সদস্য তথা বেঙ্গল ইনচার্জ সব্যসাচী গোস্বামী ওরফে কিশোর দা’ কে গ্রেফতার করে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। তার কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সমেত আর যা যা উদ্ধার হয় তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল মাও নথিপত্র, পত্র-পত্রিকা।
এইসব নথি ঘেঁটে তার তথ্য বার করতেই প্রথম দিন থেকে হিমশিম অবস্থা হচ্ছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের কর্তাদের। গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার হওয়া নথিপত্রের পৃষ্ঠা ছিলো হাজার দুয়েক। তাকে হেফাজতে নেওয়ার পর তাঁর কাছে থাকা ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে যা মিলেছে তা প্রিন্ট করে পৃষ্ঠার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। ফলে সবে মিলিয়ে প্রায় ১২ হাজার নথি ঘেঁটে তথ্য বের করে এনে তা কার্যকর করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাই প্রায় এক পক্ষকাল ধরে রাত জাগছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ-সহ বিভিন্ন এজেন্সি।
[আরও পড়ুন: একদিনেই তিন কোটি পার! ভক্তদের অনুদানের ঢল রামমন্দিরের তহবিলে]
শীর্ষ মাওবাদী নেতাকে ১৪ দিন হেফাজতে নিয়ে রাজ্য পুলিশ ছাড়াও জেরা করেছে এনআইএ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরালা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, উত্তরাখন্ড, অসম পুলিশ-সহ রাজ্যের সিআইডি ও এসটিএফ। ওই ১৪ দিন হেফাজত শেষে কাল শুক্রবার, সাধারণতন্ত্র দিবসে তাকে পুরুলিয়া আদালতে তুলবে পুলিশ। ফলে গ্রেপ্তারের পরের দিন পুরুলিয়া আদালতে যে পুলিশি ব্যবস্থা ছিল। তার চেয়ে ঢের বেশি কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় কাল আদালতে আনা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। সাধারণতন্ত্র দিবসের মতো দিনে কোনরকম ঝুঁকি নিতে চায় না পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ” জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।যে সকল তথ্য মিলছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
এই মাও শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই তাঁকে একটু অন্যভাবে দেখছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। একজন অপরাধীদের প্রতি যে ব্যবহার করা হয় সেই আচরণ অবশ্য পুলিশকর্তাদের কাছ থেকে পাননি এই শীর্ষ মাও নেতা। কিন্তু পুলিশের এমন ব্যবহারের পরেও সাংগঠনিক গত বিষয়ে সব তথ্য যে তিনি পুলিশ কর্তা সহ এজেন্সিদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তা নয়। বহু ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। তবে সেই উত্তর পেতে সব্যসাচীর কাছ থেকে পাওয়া পুলিশের হাতে থাকা ১২ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র অনেকটাই মুশকিল আসান করেছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের। টানা জেরায় দীর্ঘ প্রশ্নমালায় উত্তরহীন ‘কিশোরদা’র শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিয়েছে হাতে পাওয়া বিপুল নথির নানান জবাব।
[আরও পড়ুন: বিহারের রাজনীতিতে নতুন ‘নাটক’! লালুদের ছেড়ে বিজেপির হাত ধরবেন নীতীশ?]
বর্তমানে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনে সব্যসাচীর মত তাত্ত্বিক নেতার লেখনী শক্তি খুবই কম। তাই ধৃত কিষাণদা ওরফে প্রশান্ত বোসের মত নেতারা কিশোর দা’কে বলতেন ‘উঠতি আজাদ’। অন্ধ্র পুলিশের গুলিতে নিহত মাওবাদী পলিটবুরো নেতা আজাদের মত ক্ষুরধার লেখনী শক্তিতে বাম আমলে এই জঙ্গলমহলেও তরুণ-তরুনীদের মনে ঝড় তুলেছিল। আর এখন আজাদ পরবর্তী সব্যসাচীকে হাতে পেয়ে নথিপত্রের সঙ্গে থাকা মাও সাহিত্য ঘেঁটে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন রাজ্য পুলিশ থেকে এনআইএ-র কর্তারাও।