বাংলাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মর্যাদা দেওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেও বেশ কিছু বাঁকা কথা, ট্যারা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। কেউ সামনে তর্ক বাধিয়েছেন, কেউ সীমানার বাইরে বেরিয়ে নিন্দে-মন্দ করেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষার শিকড়ের খোঁজ আমরা থামাইনি। লিখছেন স্বাতী গুহ।
সংসারে জড়পদার্থের রহস্য যথেষ্ট জটিল দুর্গম, কিন্তু সজীব পদার্থের রহস্য একান্ত দুরূহ। ভাষা একটা প্রকাণ্ড সজীব পদার্থ। জীবনধর্মের নিগূঢ় নিয়মে তাহার বিচিত্র শাখাপ্রশাখা কত দিকে কতপ্রকার অভাবনীয় আকার ধারণ করিয়া ব্যাপ্ত হইতে থাকে তাহার অনুসরণ করিয়া উঠা অত্যন্ত কঠিন।
বঙ্গভাষা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বৈশাখ, ১৩০৫। অর্থাৎ, সময়টা মোটামুটি এপ্রিল কিংবা মে ১৮৯৮; রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর বোঝাপড়ার কথা লিখছেন ‘বঙ্গভাষা’ প্রবন্ধে। তখন থেকে এখনকার দিনের হিসেবনিকেশ করলে যা দাঁড়ায় তা হল– মোটামুটি ১২৫ বছর পর বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বসে ‘বাংলা’ নামক প্রকাণ্ড সজীব ভাষাটির রহস্য ভেদ করার চেষ্টা নেহাত সহজ ছিল না। তা অবশ্যই একটি দুরূহ কাজ। সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সত্যিই কি নেই? সন্দেহের ভ্রুপল্লবে কুঞ্চন অনাদিকাল থেকেই গবেষককে দৃঢ়চিত্ত করে তুলেছে বলেই জটিল এবং দুর্গম পথে হাঁটতে হয়েছে বারবার।
ভারত সরকার ২০০৪ সাল থেকে ভাষাগুলিকে মর্যাদা দিতে ‘ধ্রুপদী’ গৌরবের অধিকার দেওয়ার যে-উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাতে একে একে যুক্ত হয় ছ’টি ভাষা। সর্বশেষ সংযোজন আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের ভাষা ওড়িয়া। সময়টা ২০১৪। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর উদ্যাপনের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় উঠে আসে বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার সম্মাননা প্রদানের দাবিদাওয়ার কথা। কিন্তু কী করে এই কাজ করা সম্ভব তা নিয়ে ধারণা স্পষ্ট হয় না।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের অন্তর্গত ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইএলএসআর) প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই সারস্বত কাজকর্মে নতুনতর দিকে পদক্ষেপে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গবেষণায় তাই প্রথম থেকেই চেষ্টা ছিল নতুন পথে হাঁটার। ইনস্টিটিউটের চেয়ারপার্সন স্বয়ং উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁরই উৎসাহে বাংলা ভাষার ধ্রুপদী মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিপত্র তৈরির গবেষণার কাজ শুরু হল। ওড়িয়া দাবিপত্রটির প্রকাশিত বই এই কাজের আগামী সন্ধান পথের চলনকে বুঝতে সাহায্য করল কিছুটা। কিন্তু এটাও স্পষ্ট হচ্ছিল ক্রমশ, যে, এ-কাজ ‘জটিল’ এবং ‘দুরূহ’। হয়তো সে-কারণেই রহস্যভেদের আকাঙ্ক্ষা ও জেদ বাড়ছিল প্রতিদিন। এ-কাজ কোনও একক গবেষকের কাজ নয়। তাই ‘আইএলএসআর’-এর ‘স্কুল অফ লিঙ্গুইস্টিক স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক অমিতাভ দাসের নেতৃত্বে তৈরি হল গবেষক দল।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা বিভাগের এই প্রতিষ্ঠান ‘আইএলএসআর’-এর ভিশন ডকুমেন্টেই ছিল রাজে্যর ভাষা এবং সংস্কৃতি গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নোডাল সেন্টার হিসাবে কাজ করার ভূমিকার কথা। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রজত সান্যাল, ‘এসএনএলটিআর’-এর ভাষাতাত্ত্বিক রাজীব চক্রবর্তী, সংস্কৃত ভাষার গবেষক সোমনাথ চক্রবর্তী আর তরুণ গবেষক সায়ক বসু– মূলত এঁদের নিয়ে তৈরি হল কার্যকর গবেষক দল। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, শিলালেখ পাঠের কাজ শুরু হল জোরকদমে। কিন্তু সব নথি হাতের কাছে পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। চাহিদা বাড়ছিল গবেষকদের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্নসংগ্রহশালা ও প্রত্নখননের সাইটগুলো ঘুরে ঘুরে তন্নতন্ন করে যা খেঁাজা হচ্ছিল তা আসলে বাঙালির শিকড় সন্ধানের প্রয়াস।
ঔপনিবেশিক শিক্ষা বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছিল মাঝে মাঝেই। বাংলা একটি নব্য-ভারতীয় আর্য ভাষা বই অন্য কিছু নয়, এমন বিশ্বাসের বয়সও বেশ কিছুটা। বিদ্যায়তনিক শিক্ষাব্যবস্থা বেশিরভাগ সময় যে-অচলায়তনে বাধা পড়ে, সে তো আমাদের ভালোভাবেই জানা। তাই সেই নিয়ম মতে চলতে-চলতে ভাবনাচিন্তার নতুনত্ব স্বীকার করে নেওয়া সহজ হয় না। তাই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সারস্বত-সাধকদের কাছেও বাংলা ভাষার প্রাচীনতাকে নিয়ে কাজের বহর ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কেউ সামনেই তর্ক বাধিয়েছেন আর কেউ সীমানার বাইরে বেরিয়ে নিন্দে-মন্দ করেছেন। এমনকী, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মর্যাদা দেওয়ার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও বেশ কিছু বাঁকা কথা, ট্যারা প্রশ্ন জন্ম নিতে থাকে। অবশ্য এসব একদিক থেকে সুবিধার। কারণ ‘নেতি’-র মধ্য দিয়ে যাত্রা করে ‘বিশেষ’- পৌঁছনোই তো ভারতীয় জ্ঞানমার্গের দিশা। আসলে কোনও পণ্ডিত ব্যক্তির জানাই যে শেষতম জ্ঞান নয়, বরং সেখান থেকেই শুরু হতে পারে পরবর্তী সন্ধান, এ-কথা সহজে মানতে পারে এমন মানুষ সংখ্যা নেহাত করগোনা।
জুন, ২০২২ সালে প্রথম ওয়ার্কশপে যখন মহাস্থানগড়ের পাথুরে লেখের প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার কথা জানানো হল, তখন কিন্তু দ্বিগুণ উৎসাহে কাজের গভীরে আরও বেশি করে প্রবেশ করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন স্বয়ং চেয়ারপার্সন, ‘আইএলএসআর’। ইতিহাস যেন মুক্তি পাচ্ছিল ক্রমশ একটি জাতির অস্তিত্বের অতীত সন্ধানে। অধ্যাপক দাসের নেতৃত্বে গবেষক দলটি নিউ টাউনের ক্যাম্পাসে আক্ষরিক অর্থে রাত-দিন কাজ করে চলেছিল।
বাধা সেখানেও পায়ে-পায়ে। অনেক পুরনো কম্পিউটার কাজ করার সময়, তাতে লেখা যতটা হয়, তার থেকে ডিলিট হয়ে যায় ফাইলের-পর-ফাইল! ব্যক্তিগত ল্যাপটপের সঞ্চয়ক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায় নিমেষে। প্রিন্টার শুধু থেমে থেমে বার্তা পাঠায় ‘জব স্টোরেজ’ ইত্যাদি প্রভৃতি। হায়ার এডুকেশন কাউন্সিলের অফিস থেকে ধার করে গবেষণাগারে নিয়ে আসা হয় কখনও প্রিন্টার, কখনও কম্পিউটার। যাদের কর্মক্ষমতা ততদিনে একেবারে শেষে এসে পৌঁছেছে।
কাজের এই চাপ নিতে-নিতে প্রোজেক্ট প্রধানের রক্তে শর্করা তুঙ্গে পৌঁছয়, সেই সঙ্গে সাংঘাতিক রকমের স্পন্ডোলাইসিস, বাঁ হাতের জোড় কাজ করা বন্ধ করেছে প্রায়। ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি শিবাজি ঘোষের তৎপরতায় একজন সাহায্যকারী মেলে, যিনি হাওয়ার গতিতে টাইপ করে দিতে থাকেন প্রয়োজনীয় তথ্যের লিখিত অংশগুলো।
ভাষাতাত্ত্বিক শহীদুল্লাহর উল্লেখের পথ ধরে যখন অধ্যাপক দাস পৌঁছচ্ছেন অষ্টম শতাব্দীর সংস্কৃত-চাইনিজ অভিধানের রহস্যোন্মোচনের দিকে, তখন সবচেয়ে বড় গেরো বাধল সেই চিনা লিপির পাঠোদ্ধার নিয়ে। বর্তমান চিনা ভাষার পণ্ডিতগণ সেই ‘ওরাকেল বোন’ লিপি পাঠে প্রায় অপারগ। কিন্তু অসাধ্য সেই কাজকেও সেরে ফেলার পদ্ধতি খুঁজে বের করেন তঁারা।
ফরাসি ভাষার অধ্যাপক প্রণবেশ চক্রবর্তী প্রবোধচন্দ্র বাগচীর ফরাসি অনুবাদ পাঠে সহায়ক হয়ে ওঠেন। বাংলা ভাষার শিকড় সন্ধান দাবিপত্র সম্পাদনার কাজে জুড়ে যান ইনস্টিটিউটের ‘স্কুল অফ ট্রান্সলেশন অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক অনিন্দ্যশেখর পুরকায়স্থ ও তাঁর গবেষকরাও।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে উচ্চশিক্ষা বিভাগ এই গবেষণা প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করেছে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন ভাষার অ্যাকাডেমি এবং ‘তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ’-এর প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালা ও তার পত্রপত্রিকার জোগান দিয়েছে প্রয়োজন মতো। মুখ্যমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বাংলা ভাষার ধ্রুপদী যোগ্যতা বিষয়ে দাবিটি পেশ করেছেন– যা পৃথিবীর তাবৎ বাঙালির কাছে একটি ঐতিহাসিক এবং গর্বের বিষয়। ২০২৪ সালের শরৎকাল বাঙালির ইতিহাসে অবশ্যই একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বাঙালি বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষা শিখবে না– এ দাবি এখন আর কেউ করে না। কোনও জাতির কাজের ভাষা, জ্ঞানের ভাষা, যোগাযোগের ভাষা একটি মাত্র হতে পারে না– এই বর্তমান বিশ্বে। কিন্তু পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর সমবয়সি হিসাবে বাঙালির সংস্কৃতি, সাহিত্য ও কর্মোদ্যোগের যে-চিহ্নগুলোর সন্ধান পাওয়া গেল ধ্রুপদী গবেষণায়, তা বাঙালিকে নিশ্চয়ই নতুন করে উৎসাহিত করবে ‘জাতি’ হিসাবে নিজের ভাষাকে সম্মান করার কাজে। গবেষণা তথা সংস্কৃতির খনন চলবে আরও অনেকটা দূর। ইতিহাসের পাঠ এভাবেই জায়মান থাকবে আগামী প্রজন্মেও। সুদূরের পিয়াসী বাঙালি। ঘরের চাবি ভেঙে এভাবেই ইতিহাসের পাঠকে বিশ্বের অঙ্গনে নব-নব রূপে প্রতিষ্ঠার কাজ করে চলবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক ডিরেক্টর, আইএলএসআর
director.ilsr@gmail.com