খালি গলায় গান ধরলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী৷ পাঁচ হাজার শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ৷ একসময় মধ্যবিত্ত শহরের অভিজাত সংস্কৃতি ছিল জলসা৷ কার্তিকের হিমে আজও জড়িয়ে আছে মনকেমন৷ তবু ডলবি ডিজিটাল ফাংশনের যুগে বাঙালির সেই জলসাটা আজ আর নেই৷লিখলেন সরোজ দরবার
Advertisement
যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে খানিকক্ষণ বন্ধ ছিল বেলেঘাটার এক জলসা৷ মঞ্চের ওপারে তখন শিল্পীরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত৷ এমন সময় একজন অল্পবয়সি যুবক বললেন, ‘ও মশাই আমারে গাইতে দ্যান না, আমার ওসব মাইক-ফাইক লাগে না৷’ সামনে তখন বসে হাজার পাঁচেক শ্রোতা৷ শিল্পীরা একে অপরের গা টেপাটেপি করছেন৷ বলে কী! এত লোকের সামনে খালি গলায় গাইবে কী করে? শ্রোতাদের উসখুসানি আঁচ করে দ্বিধা করেননি উদ্যোক্তারা৷ গাইতে উঠলেন যুবক৷ আর বাকিটা ইতিহাস৷ খালি গলায় ওই যুবক সেদিন যা গাইলেন তাতে দর্শকরা তো মন্ত্রমুগ্ধ৷ ‘মাঝি রে’ বলে চড়ার সুরে তিনি যতক্ষণ স্বর স্থিত রাখলেন, তাতে তাক লেগে গেল অপেক্ষমান শিল্পীদেরও৷ গান শেষে সকলেই জানতে চাইলেন, কে এই যুবক? জানা গেল, তিনি সিলেট থেকে এসেছেন, নাম নির্মলেন্দু চৌধুরী৷ বাঙালিকে এরপরে আর বলে দিতে হয় না কোন ইতিহাসের সাক্ষী ছিল সেদিনের জলসা৷
এভাবেই কেবলই মুহূর্তের জন্ম হত সেদিনের সে সব জলসায়৷ যিনি এ গল্প শুনিয়েছিলেন তিনিও তো বাংলা সংগীতের আর এক দিকপাল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ এরকমই জলসার ম্যাজিসিয়ান ছিলেন তিনি নিজেও৷ ক্রিক রো-র বিখ্যাত ভানু বোসের জলসায় নায়ক বিশ্বজিৎ যখন স্টেজে উঠে ইতস্তত করছেন, তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই সুদর্শন গায়ক৷ তারপর সমবেত দর্শককে বললেন, আপনারা বরং এঁকে দেখুন আর আমার গান শুনুন৷ বলেই ধরেছিলেন, ‘মায়ামৃগ’ ছবির সেই ‘মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য’৷ ব্যস মুহূর্তে সেই ম্যাজিক৷ তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল চারিদিক৷ সেকালের এ জলসায় নাকি পেশাদারিত্ব তুলে রেখে শিল্পীরা থাকতেন রীতিমতো আড্ডার মেজাজে৷ কার কখন গানের সময় তা গৌণ৷ জলসার আক্ষরিক অর্থ মেনে সম্মিলনটা বা নৃত্য-গীতের এই বৈঠকি মেজাজটাই সকলকে পেয়ে বসত৷ আর তাই উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী শ্যামল মিত্র জমিয়ে লুচি-মাংস খেয়ে গান করে সারা রাত আড্ডা দিয়ে তবে ফিরতেন৷ এ সবই পেয়েছি অগ্রজ সাংবাদিক শংকরলাল ভট্টাচার্যের লেখায়৷ শব্দে শব্দে তিনি যে জলসার ছবি এঁকেছেন, সেই কোলাজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির অভিজাত সংস্কৃতির একখানা মিষ্টি গন্ধ মাখা খাম তিনি রেখে দিয়েছেন আমাদের প্রজন্মের জন্য৷ যে চিঠির উপর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ লিখে রাখতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু এই ইউ-টিউব শাসিত যুগে তার উপায়ই কোথায়! বাঙালির সেই জলসাটা আজ আর সত্যিই নেই৷
জলসা সেদিন ছিল বাঙালির স্বতন্ত এক সংস্কৃতিই৷ উদ্যোক্তা যেই হোন না কেন, কৌলীন্যের অভাব ছিল না৷ আলাদা আলাদা শিল্পীর ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ও ছিল আলাদা৷ শাস্ত্রীয় সংগীতে মশগুল কোনও শ্রোতা যদি পান্নালাল বা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গায়নের শুদ্ধাভক্তিতে মজে যেতেন, তবে অল্পবয়সিদের জন্য বাঁধাধরা ছিল মানবেন্দ্রর ‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’৷ সববয়সি মহিলাদের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন মঞ্চে উত্তমকুমারের ওঠা৷ আজ কানে কানে হেডফোনের সময়ে ভাবি, কী করে সেদিন জলসা বাঙালির সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল? এই উদ্যোক্তাদের অনেকেই ছিলেন যাঁদের সামাজিক পরিচয় ছিল ‘মস্তান’৷ কিন্তু হালের রাজনৈতিক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের থেকে এঁদের চরিত্রের যে অনেকটাই ফারাক ছিল তা আন্দাজ করতে পারি৷ বিশেষত ওই ভানু বোসের জলসার ছবি অগ্রজ সাংবাদিকের কলমে পড়তে পড়তে অনুভব করি, গায়ক-নায়ক মিলে গানের সূত্রে যে সামাজিক সম্মিলনের ব্যবস্থাপনা তিনি সেদিন করতে পেরেছিলেন, আজকের তুখোড় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাও বোধহয় তার সামনে হোঁচট খেত৷
সেদিন ২৪ ঘণ্টা এফএম-এ গান বাজত না, চাইলেই ইউ-টিউবের দরজা খোলা ছিল না শ্রোতাদের সামনে৷ সেদিন রেডিও ছিল তাই পরিবারের এক অন্যতম এক সদস্য৷ ‘অনুরোধের আসর’ ছিল সেদিন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে৷ বাঙালির পুজোর গান তখন যেভাবে তৈরি হচ্ছে, তাই-ই পরে স্বর্ণযুগের গানের স্বীকৃতি পাবে৷ পুজোয় যে গান জনপ্রিয়তা পেল, লোকের মুখে মুখে ফিরল, তাই যখন সাক্ষাৎ শিল্পীর মুখ থেকে শোনার সুযোগ মিলত, তখন তার উন্মাদনাটা আঁচ করা যায়৷ তখনও বাঙালির অবসর ছোটপর্দায় ঢুকে পড়েনি৷ এই সেদিনও শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য পুজোর গানের স্মৃতিচারণায় বলছিলেন, পুজোর গানের রেকর্ডকে রীতিমতো বুকে আঁকড়ে রাখতেন তাঁরা৷ বাংলা গানের প্রতি বাঙালির ছিল নাড়ীর টান৷ সেদিন তাই জলসা যে মাধুর্যে পৌঁছেছিল তা আজ ওই মিষ্টি গন্ধমাখা মুখবন্ধ খামই মাত্র৷
তারপর জলসার ঢঙে বহু রদবদল হয়েছে৷ এই যে জলসার ছবি এঁকেছেন শংকরলালবাবু, তা একসময় বন্ধ হয়ে যায় নানা কারণে৷ তবে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাঙালির জলসার অভাব ছিল না৷ একসময় অমুখ কণ্ঠী, তমুখ কণ্ঠী শিল্পীর গানেরও ব্যাপক কদর ছিল গ্রামে-মফসসলে৷ কোনও কোনও বিশেষ শিল্পীর জন্য উন্মাদনা থাকত তুঙ্গে৷ অন্তত এক মাস আগে থেকে বিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রচার করা হত এবারের বিজয়া বা কালীপুজোয় গাইতে আসবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে৷ প্রায় লোক ভেঙে পড়ত ওই অনুষ্ঠানগুলোয়৷ তবে জলসা এই পর্ব থেকেই মূলত ফাংশন হয়ে উঠল৷ তখনও সিন্ডিকেটের দাপট বাংলার সংস্কৃতি গ্রাস করেনি৷ জলসারও রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়নি৷ পরে বাংলায় এক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার হাত ধরে মুম্বই ও কলকাতার শিল্পীদের নিয়ে যে বিরাট অনুষ্ঠান হয়েছিল, তার হাত ধরেই অলিতে-গলিতে ‘বম্বেফেরত’ শিল্পীদের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল৷ বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা একসময় বিশেষ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন এই ধরনের ‘ফাংশন’ করার ক্ষেত্রে৷ তবে আজ তারও বাজার পড়েছে৷
ফাংশন আজও হয়৷ বলা বাহুল্য সে ফাংশনে জলসার কৌলীন্য নেই৷ নেই কারণ বাংলা গানও আজ আর বাঙালির কাছে সে কদরের জায়গায় নেই৷ অস্বস্তিকর হলেও মানতে হবে, আজ যে এফএম চ্যানেলে প্রজন্ম মশগুল, সেগুলোয় বাংলা গান বাজে খুব কম৷ টেলিভিশনের হাজারও বিনোদনের পসরা বাঙালির অবসর তো কেড়ে নিয়েইছে, তার গান শোনার বাসনাও বেঁধে দিয়েছে রিয়্যালিটি শোয়ের সময়সীমায়৷ ফলে অনন্ত নক্ষত্রবিথী থাকলেও অন্ধকারকেই বুকে বেঁধে বিশ্বায়নের জমানায় বাঙালির গানযাপন৷ এর উপর আছে রাজনীতির এলাকা দখলের সংস্কৃতি৷ ফলে যে সব সাংস্কৃতিক উপলক্ষ এক কালে জলসার জন্ম দিত, তাইই পড়ল বিভেদের সীমানাতে৷ বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের ব্যাপক রদবদল তাকে যে রঙ্গোলির যাপনে অভ্যস্ত করে তুলল, তা আর ফিরে দেখতে চায় না মায়ামৃগকে৷ অথবা দেখে নস্ট্যালজিয়ার আদিখ্যেতায়৷ আজ যে কোনও কাজই যখন বিজ্ঞাপনের দেখনাদারির আশ্রয় খোঁজে, ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক ফায়দা তোলার প্রতিযোগিতায়, তখন বাংলায় যে থাকবে না আর কোনও বিশুদ্ধ জলসা এ একরকম ভবিতব্য৷ সুতরাং বনে নয় মনেই এখন পাখি গান গায়৷ এই কার্তিকের রাতে হিম পড়লে, ওই দূরে পুরনো কোনও বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বলে উঠলে, ডলবি ডিজিটালের গমগমে আওয়াজে চিকনি চামেলিরা রঙচঙে আলোর ফোয়ারায় মঞ্চে নেচে উঠলে, কেউ বা কারা যেন ফিরে যায় সেই জলসার দিনকালে৷ স্মৃতির ময়ূরপঙ্খী পাড়ি দেয় উজানস্রোতে৷ আর বাঙালির বর্তমান অতীতের সেই জলসার মুখোমুখি হতে চেয়ে হয়তো বলে ওঠে, ‘…একটুখানি দাও অবসর বসতে কাছে/ তোমায় আমায় অনেক যুগের অনেক কথা/ বলার আছে৷’
কে জানে বাঙালির হাতে আজ আর সেই দু’দণ্ডের অবসর আছে কি না!
The post বাঙালির সেই জলসাটা আজ আর নেই! appeared first on Sangbad Pratidin.