বিশ্বদীপ দে: বঙ্গজীবনের অঙ্গ। না, সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিমের কথা হচ্ছে না। ভোটযুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে। এই অবস্থায় অঙ্গ, বঙ্গের সঙ্গে দিব্যি মিলে যায় ভোটরঙ্গ। এও তো বাঙালির এক আপন ঐতিহ্য। গোটা দেশের নিরিখে বাংলাতেই বোধহয় সবচেয়ে আশ্চর্য সব স্লোগান, দেওয়াল লিখনের জন্ম হয়েছে। এই ভরা ইউটিউবের জমানাতেও তার ভেলকি ভালই মালুম পাচ্ছেন সবাই। সে আপনি যে দলেরই সদস্য হোন না কেন, সিপিএমের (CPM) ‘টুম্পা’, তৃণমূলের (TMC) ‘খেলা হবে’ কিংবা বিজেপির (BJP) ‘পিসি যাও’-এর মুচকি সরসতাকে উপেক্ষা করা কঠিন, হয়তো অসম্ভবও। হালের এই সব গানের কথার রেশ নস্টালজিয়া-প্রিয় মানুষকে পৌঁছে দেয় সুদূর অতীতের দরজায়। সেই কোন হারিয়ে যাওয়া অতীত থেকে গান গেয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র পণ্ডিত। মনে করিয়ে দেন, এই খেউর, কবির লড়াই, তরজা, রঙ্গব্যঙ্গ বাঙালির বড় আপন সংস্কৃতি। স্বাভাবিক ভাবেই যার প্রতিফলন গিয়ে পড়েছে রাজনৈতিক জগতেও।
নেতামন্ত্রীদের ভোট-আকাঙ্ক্ষাকে হাসির চাবুকে রাঙা করে তুলে ‘দাদাঠাকুর’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত লিখেছিলেন, ”ভোট দিয়ে যা/ আয় ভোটার আয়। মাছ কুটলে মুড়ো দিব/ গাই বিয়োলে দুধ দিব, দুধ খেতে বাটি দিব।” ইত্যাদি। শেষে এসে মোক্ষম ধাক্কা, ”কোনও কাজে লাগব না/ যাদুর কপালে আমার ভোট দিয়ে যা।” চেনা ছড়াকেই কেবল নয়, সেই সময়ের ‘হিট’ গানের লাইনকেও পালটে তিনি করেছিলেন, ”আমি ভোটের লাগিয়া ভিখারি সাজিনু/ ফিরিনু গো দ্বারে দ্বারে।” কত বছর আগের লেখা! কিন্তু আজও অনতিক্রম্য। ভোটের বাজারে এর আবেদন কখনও ফিকে হবে না।
[আরও পড়ুন: ভোটগণনার দিনই জন্মশতবার্ষিকী সত্যজিৎ রায়ের, আদৌ উদযাপন হবে? শঙ্কায় ভক্তকুল]
ভোটের (Election) গানের আঙ্গিক বদলেছে। তেমনই বদলে গিয়েছে আক্রমণের ভাষাও। তবে ভিতরে ভিতরে মিলটাও কম নেই। পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠস্বরে শ্যামাসংগীত ‘আমার সাধ না মিটিল’-কে পালটে দিয়ে ১৯৫৭-৫৮ সালে সিপিআই তৈরি করেছিল এক অনন্য লিরিক্স- ”আমার সাধ না মিটিল/ ফাঁড়া না কাটিল/ মেয়াদ ফুরায়ে যায় মা।/ জনমের শোধ ডাকি গো/ মা তোরে/ এবার জেতাবি আয় মা।” এটা কোনও বিক্ষিপ্ত উদাহরণ নয় মোটেই। সেযুগে এমন প্যারডি ভূরি ভূরি রয়েছে। জানালেন বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও লেখক দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়। তবে তখনও দেওয়াল লিখন ব্যাপারটা চালু হয়নি। কাগজে লিখে পোস্টার বানানো কিংবা দরমার গায়ে কাগজ সেঁটে তাতে লিখে তা বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে দেওয়া হত। তাহলে দেওয়াল লিখন শুরু হল কবে? দেবাশিসবাবুর কথায়, ”আজ যেভাবে দেওয়াল লিখন ছড়িয়ে পড়েছে, তা মূলত শুরু হয় ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পরে। একে দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়েছিল নকশালরা।”
আর নকশাল আমল বললেই চলকে ওঠে উত্তাল সত্তর। দেওয়ালে দেওয়ালে ”চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” কিংবা ”তোমার নাম, আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম”। শেষোক্ত পঙক্তিটি সম্পর্কে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন এটা দেওয়াল লিখন নয়, ‘দেওয়াল কবিতা’। নতুন সহস্রাব্দে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) সেই স্লোগানকেই নতুন করে তুলেছিলেন। ”তোমার নাম আমার নাম নন্দীগ্রাম”। চায়ের টেবিলে ঝড় তোলা বিতর্কে অনেকেই পুরনো দিনের কথা তুললে নাক কুঁচকে বলে ওঠেন, ওই সব স্লোগানের জায়গায় আজকে ‘টুম্পা’র মতো সব গানের ভোট বাজারীয় সংস্করণ কি মেনে নেওয়া যায় নাকি? আসলে ”আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” এই অনুযোগ সবক্ষেত্রেই থাকে। ঘটনা হল, ওই নকশাল আমলেই সিদ্ধার্থশংকর রায়ের কংগ্রেস (আই)-এর দেওয়াল লিখনেই যে ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছিল তা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। ”চিনের চেয়ারম্যান তোদের বাপ, ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মা।” ছয়ের দশকের জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সেই আংশিক দৃষ্টিহীনতাকে ব্যঙ্গ করে ছড়া বাঁধা হয়েছিল, ”জলের শত্রু কচুরিপানা, দেশের শত্রু অতুল্য কানা”। এই ভাষাই বুঝিয়ে দেয় আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে বহু ক্ষেত্রেই কোন হীন স্তরে পৌঁছে যেত বিষয়টা।
[আরও পড়ুন: আদি বনাম নব্য BJP’র লড়াই! সরানো হল বর্ধমানের সাংগঠনিক জেলা সভাপতিকে]
সেই তুলনায় সামগ্রিক ভাবে এখন ভোটের গান, স্লোগানের ভাষায় বৈচিত্র যে অনেক বেড়েছে তা মেনে নিচ্ছেন দেবাশিসবাবুর মতো বিশেষজ্ঞরা। হালের ‘টুম্পা’-র মতো ‘পিসি যাও’ প্যারডিও যার মোক্ষম উদাহরণ। উনবিংশ শতকে ইতালির প্রতিবাদের গান ‘বেলা চাও’ অক্লেশে ২০২১-এ এসে বিজেপির হাতে পড়ে ‘পিসি যাও’ হয়েছে। এবং ‘খেলা হবে’। তৃণমূল ছাত্রনেতা দেবাংশু ভট্টাচার্যের দাবি, মাঠে বসে মিনিট কুড়ির মধ্যে এই গান লিখেছিলেন তিনি। যদিও এমনও শোনা যায় বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল নাকি তারও আগে এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। আরেকটা দাবিও রয়েছে। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সাংসদ শামিম ওসমান বছরকয়েক আগে এই স্লোগান ব্যবহার করেছিলেন। তবে যিনিই প্রথম ‘খেলা হবে’ বলে থাকুন না কেন, একে জনপ্রিয়তার শিখরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন দেবাংশুই। উত্তরবঙ্গের এক সভায় ওই স্লোগান তুলে ছড়া কাটেন তিনি। সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায় নিমেষে। ছড়িয়ে পড়ে ওই স্লোগান। ভোটের বাজারে যা ক্রমেই পারদ চড়াচ্ছে। ডিজে গানের তালে তালে নেচে উঠছে সমর্থকরা।
সময় বদলায়। ভোট আসে। চলেও যায়। এক ভোটের স্লোগান অন্য ভোটে গিয়ে ‘বাসি’। চোখের সামনে জেগে থাকা দেওয়াল লিখন মুছে গিয়ে অন্য ভাষ্য ফুটে ওঠে। সত্যি কি ভোটারদের মধ্যে বিরাট প্রভাব ফেলে এই সব ভোটরঙ্গ? বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটের হিসেব অনেক জটিল। নানা ফ্যাক্টর সেখানে জালের মতো ছড়িয়ে থাকে। নিছক চোখ ধাঁধানো কোনও স্লোগান কিংবা মুচকি কার্টুনের সপাট মোচড় ভোট ব্যাংকে প্রভাব ফেলে না। তবে এর বিনোদন মূল্যকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। তাছাড়া এর মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়াও সহজ। সেটাকেই কাজে লাগায় দলগুলি। তৈরি হতে থাকে নিত্যনতুন সব গান। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়ে যায় কত অদ্ভুত সব স্লোগান। প্রতিটি নির্বাচনের স্মৃতির সঙ্গে যা মিশে যায় ওতপ্রোত ভাবে।