সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: মহামতি সম্রাট অশোক। ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা, যিনি শুধুমাত্র সুশাসনের জন্য নয়, এ দেশে বৌদ্ধধর্মের (Buddhism) প্রসারের জন্যও তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী। ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ২,৩২৯ বছর আগে এই ভূখণ্ডে জন্ম হয়েছিল তাঁর। যদিও কোনও নির্দিষ্ট দিন বা তারিখের কোনও উল্লেখ কোথাও নেই। কোনও শিলালিপি বা মুদ্রালিপি এ নিয়ে কোনও তথ্য দিতে পারে না। অথচ ঐতিহাসিক কোনও তথ্য ছাড়াই কয়েক বছর ধরে আচমকাই ১৪ এপ্রিল বিহারে(Bihar) ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওই দিনই আবার ভারতীয় সংবিধানের জনক, ভীমরাও রামজি আম্বেদকরেরও (BR Ambedkar) জন্মদিন।
ভাবছেন এ আবার কীভাবে সম্ভব? সূত্রপাত আগেই হয়েছিল। ২০১৫ সালে। মৌর্যদের তৃতীয় সম্রাটের জন্মতারিখ আচমকাই ‘আবিষ্কার’ করে ফেলেছিল বিহার সরকার। তাঁর জন্মের ২,৩২০ বছর পর। রীতিমতো ডিক্রি জারি করে, ঢ্যাড়া পিটিয়ে এই শুভ দিন ঘোষণা করে ‘মহাগাঠবন্ধন’ সরকার। দেখা যায়, বিন্দুসার-পুত্র আর আম্বেদকরের জন্মদিন একই! ১৪ এপ্রিল। কিন্তু ইতিহাসবিদরা (Historian) কী বলছেন? তাঁরা কি আদৌ এই আবিষ্কারকে সিলমোহর দিয়েছিন?
[আরও পড়ুন: ইডেনে আজ ফিরতে পারেন বোলার রাসেল, কোচের নির্দেশ মাঠে পরিষ্কার করলেন রানারা]
উত্তর, না। কেউ কিচ্ছুটি বলেননি। মাটি ফুঁড়ে আচমকা কোনও প্রাচীন পাঁজি-পুঁথি বা প্রামাণ্য নিদর্শনও উজিয়ে বেরিয়ে আসেনি। ইতিহাসের কোনও দলিলে অশোকের জন্ম তারিখ বর্ণিত নেই। আছে কেবল সম্ভাব্য সময়কালের উল্লেখ। তাই বিহার সরকারের এই আজব ঘোষণা শুনে ঐতিহাসিক থেকে শিক্ষাবিদ, প্রত্যেকেই কার্যত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এমন দাবির যে কোনও ভিত্তি নেই, ন’বছর আগেই সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা।
ঠিক কী হয়েছিল? সালটা ২০১৫। জেডি (ইউ)-এর মুখপাত্র অজয় অলোক ঘোষণা করলেন, মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসকের জন্মদিন তাঁরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আর তা হল ১৪ এপ্রিল। কিন্তু সেদিন তো আম্বেদকরেরও জন্মদিন! অজয়ের দাবি, ‘‘সেই জন্যই অশোকের সঙ্গে আম্বেদকরকে ‘ট্যাগ’ করা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশেও এমন করা হয়েছে।’’ এর সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, ‘‘জানি, সম্রাট অশোকের জন্মদিনের কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তবে বৌদ্ধরা ১৪ এপ্রিল ‘এনলাইটমেন্ট ডে’ হিসাবে পালন করেন।’’ প্রসঙ্গত, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। অন্যদিকে, ১৯৫৬ সালে আম্বেদকরও হিন্দুত্ব ছেড়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। জেডি (ইউ) (JDU) নেতার যুক্তির নির্যাস ছিল সেটাই।
[আরও পড়ুন: শিক্ষা দুর্নীতি মামলা: এজেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা! বড়ঞার তৃণমূল বিধায়কের বাড়িতে সিবিআই হানা]
তবে আসল কথা ছিল অন্য। আসলে বিহারের কুশওয়াহারা মনে করেন, অশোক তাঁদেরই সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। তাঁদের চাপে পড়েই সেই সময় আরজেডি, জেডি (ইউ) নেতারা এই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হন। মূলত, কুশওয়াহাদের ফিরিয়ে আনতেই ছিল এই ‘চাল’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরজেডি-র এক শীর্ষনেতা তা পরে কবুলও করেছিলেন। ওই সময় সুরজনন্দন প্রসাদ নামে এক বিজেপি নেতা এও দাবি করেছিলেন যে, তাঁর দলের কাছে প্রমাণ আছে অশোক কুশওয়াহা সম্প্রদায়েরই ছিলেন। ২০১৫ লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির সমর্থনে এই কুশওয়াহারা (রাষ্ট্রবাদী কুশওয়াহা পরিষদ) ১৪ এপ্রিল সম্রাট অশোকের জন্মদিন রাজ্যজুড়ে পালন করে। সেখানে বেশ কিছু বিজেপি নেতাও ছিলেন।
তবে রাজনীতির জাঁতাকলে ইতিহাসকে নীরবে পিষতে দেখে চুপ করে থাকেননি ইতিহাসবিদরা। অশোক-বিশারদ ইতিহাসবিদ তথা লেখিকা নয়নজ্যোতি লাহিড়ির প্রতিক্রিয়া, ‘‘কোনও শিলালিপি, মুদ্রালিপি বা লিখিত দলিলে সম্রাটের (King Ashoka) জন্মসাল বা তারিখের কোনও উল্লেখ নেই।’’ আবার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা ডি এন ঝা’র মতে, ‘‘বিহার সরকারের এই ঘোষণায় আমি হতবাক। জানি না, কে মুখ্যমন্ত্রীকে এই আজব পরামর্শ দিয়েছিলেন?’’ ঘটনার নেপথ্যে রাজনীতির ছায়া দেখেছিলেন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান রাজেশ্বর প্রসাদ সিং। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এর আগে বিজেপিও এই চেষ্টা করেছিল। কুশওয়াহাদের কাছে টানতে চেয়েছিল ওরাও। কিন্তু ইতিহাসে অশোকের জাতি নিয়ে কোনও তথ্য নেই।’’